মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে আজ শুক্রবারও রাজপথে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন কয়েক হাজার শিক্ষক। লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির একাদশ দিনে শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি জানাচ্ছেন। বক্তৃতার পাশাপাশি গান-কবিতায় শিক্ষা জাতীয়করণের যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন জাতি গড়ার কারিগররা।
অবস্থানরত শিক্ষকরা বলছেন, দাবি আদায়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে আলোচনা করা হলেও কোনো ফল আসেনি। উল্টো মন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলতে চান, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা অন্য চাকরি না পেয়ে শিক্ষকতা করছেন। কিন্তু তিনি জানেন না মহান পেশা শিক্ষকতায় আসতে আমাদের অনেকেই অনেক ভালো চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি। শিক্ষামন্ত্রী আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে টান দিয়েছেন। তিনি জাতি গড়ার কারিগরদের হেয় প্রতিপন্ন করছেন।
শিক্ষকরা আরো বলেন, ডা. দীপু মনি জাতীয়করণের যৌক্তিকতা ও আর্থিক সংশ্লেষ গবেষণায় দুইটি কমিটি গঠনের কথা বলেছেন। যা হবে আমলাদের মাধ্যমে। এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কোনো গবেষণা ছাড়াই ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের তিন শতাধিক কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। সরকারি হয়েছে কয়েকশ’ মাধ্যমিক স্কুল। তখন কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয়নি। সরকার যে প্রক্রিয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি করেছেন, একই প্রক্রিয়া মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি জানাচ্ছি। গবেষণা কমিটির মাধ্যমে জাতীয়করণের দাবি আদায়ের প্রক্রিয়া ঝুলে যাবে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা ঘোষণার দাবিতে আমরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি। আমরা জাতীয়করণের ঘোষণা চাই। একবারে সব প্রতিষ্ঠান নয়, আমরা চাই সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে সরকার পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি ঘোষণা করুক। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় আমাদের কোনো লাভ হবে না। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ। তার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলার পর তিনি আমাদের যে নির্দেশ দেবেন আমরা তা মাথা পেতে নেবো।
শিক্ষক নেতারা বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি সর্বস্তরের বেসরকারি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খরচ কমবে। কিন্তু কিছু ‘বেঈমান’ শিক্ষক নেতা সর্বস্তরের শিক্ষকের দাবির বিরোধীতা করছেন। তারা সরকারের সঙ্গে আতাত করে শিক্ষকদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কারণ জাতীয়করণ হলে তাদের আর খাওয়া থাকবে না। ওই শিক্ষক নেতার আর প্রবীণ শিক্ষকদের জমানো কষ্টার্জিত টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবেন না। তাই তারা সব এমপিওভুক্ত শিক্ষকের দাবির বিরোধীতা করছেন। তাদের এজেন্টরা মন্ত্রীর সামনে আন্দোলনরত সারাদেশের কয়েকহাজার শিক্ষককে স্বাধীনতা বিরোধী বলেছেন। ‘স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ’ নামধারী ওই সংগঠন শিক্ষকদের পরাধীন ও তাদের হাতে জিম্মি করে রাখতে চাচ্ছে।
গত ১১ জুলাই থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন বিটিএ নেতারা। গত ১৬ জুলাই থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝোলানোর কর্মসূচি পালন করছেন তারা। গত সোমবার অবস্থানরত শিক্ষকদের ওপর লাঠিচার্জ করেছিলো পুলিশ। গত বুধবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা। কিন্তু বিটিএ সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদের অভিযোগ, একটি শিক্ষক সংগঠনের নেতারা ওই সভায় কোনো ঘোষণা ছাড়াই ওই সভায় অংশ নিয়ে হট্টোগোল করেছেন। সভায় আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতাদের কোনো কথাই বলতে দেয়া হয়নি।
শুক্রবার বিটিএর সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদ দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা তার এ বক্তব্যের ধিক্কার জানাই। তিনি আমাদের অস্তিত্বে আঘাত করেছেন। এর জন্য যদি তার অনুভূতিতে একটুও অনুশোচনা না হয়, মাননীয় মন্ত্রী যদি তার কথাবার্তায় সামাল না হন, তিনি যদি বারবার আমাদের অস্তিত্বে আঘাত করতে থাকেন তাহলে আমরাও কঠোর হবো।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দাবি জাতীয়করণ। মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর তিনি যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তাতে শিক্ষকরা সন্তুষ্ট নন। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ। তার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারলে তিনি আমাদের দুঃখ কষ্ট বুঝে আমাদের একটি সঠিক সমাধানের পথ দেখাবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। জাতীয়করণের সুস্পষ্ট ঘোষণা বা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পেলে আমরা ক্লাসরুমে ফিরে যাবো না।
অবস্থানরত শিক্ষকরা বলছেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা মাত্র ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। একই কারিকুলামে একই সিলেবাসে পাঠদান করিয়েও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধানদের থেকে এক ধাপ নিচে বেতন দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার পর অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। তাছাড়া বিগত কয়েক বছর যাবত অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট খাতে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন থেকে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নেয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করা হলেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বর্তমান সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা স্মার্ট করতে প্রয়োজন স্মার্ট শিক্ষক। তাই স্মার্ট শিক্ষক পেতে শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ মাধ্যমিক শিক্ষা সরকারিকরণের বিকল্প নেই।
শিক্ষকরা বলছেন, একবারে না হলেও তারা ধাপে ধাপে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারিকরণ চাচ্ছেন। তারা সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা চান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় সরকারি কোষাগারে নিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণে খুব বেশি অর্থ ব্যয় হবে না।