দ্বৈত পরীক্ষকের পরিবর্তে একক পরীক্ষক পদ্ধতিতে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও ফল প্রকাশের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেশনজট নিরসন এবং ফল প্রকাশে অস্বাভাবিক বিলম্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একক পরীক্ষক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। দেশের মোট উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারীর প্রায় ৭০ শতাংশের দায়িত্ব নেয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই অধিভুক্ত কলেজগুলোর স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির পরীক্ষার খাতা দুই পরীক্ষক দিয়ে মূল্যায়ন করানো হচ্ছে। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগরসহ অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগ যুগ ধরে এ পদ্ধতি চালু রয়েছে। প্রাজ্ঞ শিক্ষকদের মতে, সম্ভাব্য স্বজনপ্রীতি-দুর্নীতি ঠেকানো, মূল্যায়নের মান এবং ভারসাম্য রক্ষার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দ্বৈত পরীক্ষক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর প্রতিটি উত্তরপত্র একজন অভ্যন্তরীণ পরীক্ষক ও অপর একজন বহিঃপরীক্ষক মূল্যায়ন করে যার যার মতো করে নম্বর দেন। পরীক্ষা কমিটি দুই পরীক্ষকের দেয়া দুই রকমের নম্বরের গড় করে একটি তৃতীয় নম্বর দিয়ে ফল চূড়ান্ত ও প্রকাশ করেন। আবার একটি উত্তরপত্রে যদি দুজন পরীক্ষকের দেয়া নম্বরে ২০-এর বেশি পার্থক্য হয়, সেক্ষেত্রে তৃতীয় পরীক্ষককে দিয়ে মূল্যায়ন করানো হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথম দুজন পরীক্ষকের মধ্যে দেয়া অপেক্ষাকৃত কম নম্বরের সঙ্গে তৃতীয় পরীক্ষকের নম্বরের গড় করে ফলাফল চূড়ান্ত করা হয়। তবে সময় বাঁচানোর লক্ষ্যে দু’-একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতেগোনা কয়েকটি বিভাগে বহিঃপরীক্ষক বাদ দিয়ে দুই পরীক্ষকই নিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাখা হচ্ছে সাম্প্র্রতিককালে।
নানাদিক বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেশে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও অন্যান্য বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগ যুগ ধরে দ্বিতীয় এমনকি প্রয়োজনবোধে তৃতীয় পরীক্ষক দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে এসএসসি, এইচএসসি এবং সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়াধীন ডিগ্রি (পাস) শ্রেণীর পরীক্ষার উত্তরপত্র একক পরীক্ষক পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হয়। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে ভর্তির আগেই ফল ও গ্রেড নিয়ে চুক্তি হয়। সুতরাং উত্তরপত্র মূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন নিয়ে কোনো বিভেদ বা বিবাদের কথা শোনা যায় না। এসএসসি ও এইচএসসিতে ফল প্রকাশের পর পুনর্নিরীক্ষার জন্য সংক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থী বোর্ডে আবেদন জানাতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী আবেদনকারীর খাতার নম্বর শুধু গুনে দেখা হয়। নম্বর গণনায় যদি ভুল হয় তবেই নতুন ফল প্রকাশ হয়। নতুন করে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষক দিয়ে খাতা পুনর্মূল্যায়ন হয় না। ১৮ বছর ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকের কাজ করেন এমন একজন শিক্ষক জানান, অনেকে হেলাফেলা করেন, খাতার পরিমাণ বেশি ও মূল্যায়নের জন্য বেঁধে দেয়া সময় কম হওয়ার ফলে নিজ ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়দের দিয়ে খাতা দেখানোর নজির রয়েছে। দ্বিতীয় পরীক্ষক না থাকলে একজন পরীক্ষার্থীর খাতা মূল্যায়নে অনিচ্ছাকৃত সর্বনাশ হলেও কোনো প্রতিকার বা প্রতিবিধান থাকবে না। এছাড়া কোনো পরীক্ষক যদি নম্বর দেয়ায় ক্ষেত্রে স্বভাবগতভাবে কৃপণ হন কিংবা স্বজনপ্রীতি বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাতা মূল্যায়ন করে কোনো খাতায় অপেক্ষাকৃত কম বা ঢের বেশি নম্বর দেন তবে তা-ই চূড়ান্ত হবে।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, উপাচার্য বলেছেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই একক পরীক্ষক পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। পত্রিকায় তার বক্তব্য পড়ে ফোন করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ফল প্রকাশের অপেক্ষারত একজনের কাছে। আগামী মাসে এ পরীক্ষার্থীর ফল প্রকাশ হবে। তিনি জানান, দুজন পরীক্ষকই তাদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন এবং এ পদ্ধতি এ ব্যাচেই শেষ। এ বিভাগের একজন শিক্ষক জানান, যারা ২০১৩-১৪ সেশনে ভর্তি হয়েছেন তাদের সময় থেকে এ বিভাগে একক পরীক্ষক পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রেও যুক্তি পরীক্ষা শেষে দ্রুততম সময়ে ফল প্রকাশের।
আরও জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসনসহ কয়েকটি বিভাগে চালু হয়েছে একক পরীক্ষক পদ্ধতি। তবে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, শাহজালাল ও ইসলামীসহ কোনো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগেই একক পরীক্ষক পদ্ধতি নেই। ঢাকা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসরণে বাদবাকিদের একই পদ্ধতি চালু করতে বাধ্য করার আশংকা করছেন জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাজ্ঞ শিক্ষকরা। একক পরীক্ষক থাকলে ওপরের নির্দেশে পরীক্ষা কমিটির পছন্দের শিক্ষক দায়িত্ব পেতে পারেন এবং এতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের সাম্প্রতিক ফলের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা সহজ হবে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের জন্য নেয়া নতুন সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও পরীক্ষকরা। তারা বলেছেন, তড়িঘড়ি সেশনজট নিরসনের কৃতিত্ব নিয়ে স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণীর খাতা মূল্যায়নের মান এবং সনদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া যৌক্তিক হবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কেউ কেউ বলছেন, টাকা বাঁচানোর জন্যই তারা এমন তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বর্তমানে স্নাতক শ্রেণীর একটি খাতা মূল্যায়নের সম্মানী ৪০ টাকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোতে অধ্যয়নত স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর শিক্ষার্থী সংখ্যা ৭ লাখের বেশি। গড়পড়তা হিসাবে বর্তমানে বিসিএস ক্যাডার পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শতকরা ৪০ ভাগই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা বলছেন, একক পরীক্ষক পদ্ধতিতে এত বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র মূল্যায়নে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হলেও তা দেখভালের কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। একক পরীক্ষক পদ্ধতি গ্রহণের পর চাকরির বাজারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সনদধারীদের একই মানদণ্ডে বিচার করার সুযোগ তৈরি হতে পারে। এতে ফলাফলে স্বজনপ্রীতি নিয়ে হৈচৈ নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঢাকা কলেজের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, বর্তমান পদ্ধতিতে একটি বিষয়ের উত্তরপত্র প্রথম পরীক্ষক দেখার পর ওই খাতাগুলো অনেক দূরের কোনো কলেজের কোনো দ্বিতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়। তিনি প্রস্তাব করেন, ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের একজন প্রথম পরীক্ষক নির্দিষ্টসংখ্যক খাতা দেখার পর নিকটস্থ ইডেন কলেজের দ্বিতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন। এভাবেই নিকটতম কলেজের প্রথম পরীক্ষক, নিকটতম দ্বিতীয় পরীক্ষক গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও ডিজিটাল পদ্ধতিতে একটি ডেটাবেজ তৈরি করে প্রথম ও দ্বিতীয় পরীক্ষক, তাদের অবস্থান এবং খাতায় দেয়া নম্বর ও গড় নম্বরের সমন্বয়ের কাজ করা যায়। এতেও সময় বাঁচবে অনেক। সেশনজট কমানোর অনেক পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। সেশনজটের অজুহাতে একক পরীক্ষক চালু ‘উঁকুন মারতে মাথা কাটা’র মতোই মনে হয়।
বি: দ্র :একই শিরোনামে সম্পাদকের এই লেখাটি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদকীয়তে প্রকাশ হয়। বিশেষ বিবেচনায় লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।