জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সারাদেশে কলেজ শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কর্মপরিসর ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পরিচালিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২,২৬৪টি কলেজ ও ইনস্টিটিউটে। তবে গত কয়েক বছরে মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল সেশনজট। চার বছরের কোর্স শেষ করতে সময় লেগে যেত ৭ থেকে ৮ বছর। বর্তমানে সে সংকট থেকে প্রতিষ্ঠানটি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ- 'শিক্ষার মানোন্নয়ন।' এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় এবং সরকারের অর্থায়নে ১০৪০ কোটি টাকার প্রকল্পও চালু হয়েছে। সোমবার (২১ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, পূর্ব বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও আগে যখন প্রাদেশিক বাংলার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, তখন ১৯২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা অনুভব এবং উচ্চারণ করেন কবি ও সাংবাদিক কাজী নজরুল ইসলাম। তখন এই শিরোনামে তিনি একটি সম্পাদকীয় লেখেন (সান্ধ্য দৈনিক 'নবযুগ', সম্পাদক : শেরে-বাংলা একে ফজলুল হক)। ভাবতে অবাক লাগে, তখন তিনি জাতীয় ভাবধারা ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় কীভাবে একটি সার্বভৌম বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করতে পারে, তার একটি পরিস্কার ধারণাপত্র উপহার দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি এক ধাপ অগ্রসর হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি নানা বিষয়ে বাঙালির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে।

গত ৬ বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়েছে বহুগুণ। প্রতি বছর আয়োজন করা হচ্ছে কলেজ র‌্যাংকিং। জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেরা কলেজকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আলাদাভাবে সরকারি-বেসরকারি এবং মহিলা কলেজগুলোকে র‌্যাংকিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে এই র‌্যাংকিং বিরাট অবদান রাখছে। কলেজগুলোতে তৈরি হয়েছে প্রতিযোগিতা। অন-ক্যাম্পাস মাস্টার্স প্রোগ্রাম এমএএস (মাস্টার্স ইন অ্যাডভান্স স্টাডিজ), ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম চালু এবং এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রাম সম্প্রসারণে বর্তমান প্রশাসনের যে সফল উদ্যোগ, তা সব মহলে প্রশংসা পেয়েছে। আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণের সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

জানুয়ারি ২০১৭-তে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম সমাবর্তন। শিক্ষক প্রশিক্ষণে আধুনিকতার প্রয়োগ এবং ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কলেজ শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত লেকচার শুনতে পাচ্ছেন। প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ডরমেটরি আধুনিকায়ন ও সংস্কারের কাজ চলছে। নির্মিত হচ্ছে তিন তারকা মানের অত্যাধুনিক ডরমেটরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থায় আনা হয়েছে আমূল পরিবর্তন। ভাড়ায় চালিত গাড়ির স্থলে পরিবহন পুলে যুক্ত হয়েছে নিজস্ব গাড়ি। আঞ্চলিক কেন্দ্রের জন্যও পরিবহন সুবিধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিবহন সুবিধা পুরোপুরি নিশ্চিত করা গেলে আঞ্চলিক কেন্দ্রের মাধ্যমে কলেজগুলোর মনিটরিং আরও সহজ হয়ে উঠবে। ২০০৭ সালে একবার ৪১টি কলেজে মনিটরিং হওয়ার দীর্ঘদিন পর বর্তমান প্রশাসন আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে পুনরায় মনিটরিং চালু করেছে। বর্তমানে নিয়মিতভাবে চলছে এই কার্যক্রম। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে 'মডেল কলেজ' ধারণার বাস্তবায়ন। প্রথম পর্যায়ে ৫টি কলেজকে প্রাক-মডেল কলেজ মনোনীত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। ওয়ানস্টপ সেন্টার তৈরি করে শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে গতিশীল সেবা। অনলাইনে ভর্তিসহ সব প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারছে কলেজ ও শিক্ষার্থী। চালু হয়েছে ই-ফাইলিং।

তবে উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে, বিরাজমান সমস্যা দূর করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে হলে এবং চলমান কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করার জন্য কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, বর্তমানে অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রাসঙ্গিক সব তথ্য প্রদানের পাশাপাশি নতুন করে যেসব প্রতিষ্ঠানে অধিভুক্তি, বিশেষ করে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদানের অনুমতি প্রদান করা হবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি ও পাঠদান অনুমতির বিস্তারিত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি এবং পিএসসিকে অবহিত করা যেতে পারে। কলেজে বিষয়ভিত্তিক আসন সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিও ওইসব প্রতিষ্ঠানকে জানাতে হবে। কেননা শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পদোন্নতি ও বদলি, বেতন-ভাতা প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে ওই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। প্রয়োজনে, সরকারের পরিকল্পনা এবং বার্ষিক বাজেট বিবেচনায় নিয়ে অধিভুক্তি, পাঠদানের অনুমতি ও আসন সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। যেসব কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয়, সেখানে প্রত্যেকটি বিষয়ে ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করার ব্যাপারে সরকারের সংশ্নিষ্ট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। ৩ থেকে ১২ জন শিক্ষক দিয়ে শত শত শিক্ষার্থীর শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়

অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের যেসব শিক্ষক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন, তারা প্রশিক্ষণ-পরবর্তী সময়ে পাঠদানে ও ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনায় নিজেদের কতটা উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন, এই সম্বন্ধে নিয়মিতভাবে মনিটরিং হতে পারে। নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অধিভুক্ত সব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কল্যাণ-অধিকার পরিষদ ও শিক্ষার্থী কল্যাণ-অধিকার পরিষদ গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এ ধরনের সংগঠনের কার্যক্রম শিক্ষার মানোন্নয়নে সরাসরি সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের চিন্তা প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অগ্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কাজ করতে গিয়ে বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। দেখা দেয় নতুন নতুন সমস্যা। সমাধানের জন্যও তাই গ্রহণ করতে হয় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একদিন হয়তো বিশ্বের শিক্ষা ভুবনে হয়ে উঠবে একটি পরিচিত নাম ও অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠান।

ড. ফজলুল হক সৈকত : শিক্ষক ও গবেষক; সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026710033416748