জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার যে ভূমিকা বাংলাদেশেও তা হবে না কেন?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সার্বজনীন মানসম্মত শিক্ষাকে জাপান উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে সফলভাবে ব্যবহার করেছে এবং জাতীয় জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। এ দিক থেকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল যে কোন দেশের জন্য ওই দেশটি নিশ্চিতভাবেই কেবল অনুসরণীয় নয়, অনুকরণীয়। এই অনুকরণটা যত ভালোভাবে করা যাবে ততই লাভ। বাংলাদেশের বিরাট লাভ হতো যদি এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিদাতা ও কনসালটেন্টদের বিদায় দিয়ে জাপানকে ঠিকমতো অনুসরণ, পারলে অনুকরণ করা হতো।বৃহস্পতিবার (২২এপ্রিল) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক উপ সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপ সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, জাপান এই শিক্ষাটি গ্রহণ করেছে পশ্চিমা বিশ^ থেকে আর তা কাজে লাগিয়েছে পশ্চিমের চেয়েও ভালো করে। অথচ অনুকরণ করতে গিয়ে জাপানিরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে একটুও হারায়নি, বরং আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, কোন ছাড় নেই। মানুষের অনুকরণ অর্থ তাই, এমনই হওয়া উচিত। এ ভাবনার বীজ তো বহুদিন আগে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বপন করে গেছেন তার ‘জাপান-পারস্যে’ লেখায়: ‘যে মুহূর্তে জাপানের মস্তিষ্কের মধ্যে স্থান পেল যে, আত্মরক্ষার জন্য ইউরোপের কাছ থেকে তাকে দীক্ষা গ্রহণ করতে হবে, সেই মুহূর্তে জাপানের সমস্ত কলেবরের মধ্যে অনুকূল চেষ্টা জাগরিত হয়ে উঠল।’ রবীন্দ্রনাথেরই কথায়: ‘ইতিহাসে এত বড় আশ্চর্য ঘটনা আর কখনো ঘটেনি।’ রবীন্দ্র-ভাবনার এ বীজই যেন বৃক্ষ হয়ে জন্মেছে ড. মঞ্জুরে খোদার লেখা দ্যু-প্রকাশিত ‘জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা’ বইটিতে।

জাপান ও বাংলাদেশের মাঝে বহু রকম মিল রয়েছে, আমিলও অনেক। দু’দেশের মাঝে এতরকম মিল থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন জাপান থেকে এত পিছিয়ে? কত পিছিয়ে? প্রায় দেড়শো বছর অর্থাৎ দেড়শো বছর আগে জাপানের সমাজ ও রাষ্ট্র শিক্ষার জন্য যা করেছিল, আমরা তার অনেক কিছুই এখনও করতে পারিনি বা করছি না। অবশ্য স্মরণীয় যে, তখন ১৮৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ইতিহাসে এক ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষের জাঁতাকলে কাতারে কাতারে প্রাণ দিচ্ছে, ভারতব্যাপী ব্রিটিশবিরোধী মহাবিদ্রোহের আগুন তখনও ধিকিধিকি জ্বলছে। এরপরে জাপান যখন একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ হয়ে পরদেশ আক্রমণে তৎপর, বাংলা তখন নিজ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। সাতচল্লিশ পর্যন্ত তার ভাইয়ে ভাইয়ে দাঙ্গা আর এরপর একাত্তর পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। অবশ্য তারপরও আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি।

আমরা হচ্ছি কথার জাতি, জাপানিরা কাজের। সেখানে সরকারি-বেসরকারি অফিসে বা ব্যাংকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সবাই কর্মী। আহা, সেখানকার কর্মীরা কত অভাগা! আমাদের দেশে অফিসে সবাই কর্তা, এরা কত ভাগ্যবান। আপনার জন্য যদি কেউ কিছু করেন তো সে আপনার প্রতি তাদের পরম দয়া, আপনার পূর্বজন্মের কোনো ভালো কাজের ফল। আমরা অফিসগুলোতে যাই ছোটবড় সব কর্মকর্তাদের সেবা করতে, সেবা পাওয়ার কথা কল্পনা করতেও সাহস হয় না! দৃশ্যত ব্রিটিশ গেছে, আছে তাদের প্রেতাত্মারা!

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশের ভাষাটাও আছে বহাল তবিয়তে। আমরাই এখন জোর করে জাপটে ধরে রেখেছি, ছাড়বো না। যদিও আমাদের আছে মাতৃভাষার জন্য রক্তপাতের গৌরবময় দৃষ্টান্ত, পৃথিবীকে আমরা একটা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপহার দিয়েছি, কিন্তু ভুলভাল ইংরেজি ভাষায় কথা বলা ও সে সঙ্গে বাংলায় ভালো লিখতে ও বলতে না পারাকেই আমরা শিক্ষার সাফল্য ও গর্ব বলে মনে করি। জাপানিরা তাদের মাতৃভাষাকে কতখানি ভালোবাসে তা দুনিয়ার কাউকে বলে বেড়ানোর প্রয়োজন মনে করে না, কিন্তু মাতৃভাষা ছাড়া কোন কাজই করে না।

সেখানকার সমাজে শিক্ষকরা পরম সম্মানিত ও নিবেদিত-প্রাণ। জাপানে সবচেয়ে মেধাবীরাই কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন। শিক্ষকের বেতন সেখানে যে কোন সরকারি চাকরির চেয়ে বেশি। আমাদের দেশেও একসময় শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ছিল অন্য যে কোন পেশার চেয়ে বেশি। ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলার গ্রামে যে রকম পাঠশালা-মক্তব ছিল, জাপানেও ছিল তেমনি। একেকজন শিক্ষকই একেকটা স্কুল চালাতেন। শিক্ষাদান ছিল তাদের কাছে ধর্মীয় কাজের মত পবিত্র। শিশুরা সেখানে লিখতে, পড়তে ও গুনতে শিখতো ভালোভাবে। উদ্দেশ্য ছিল দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে নিতে পারা। জাপানে সেটাই বিকশিত হয়ে বর্তমান রূপ নিয়েছে। আর আমাদের সেই পাঠশালার শিক্ষাব্যবস্থাটিকে ব্রিটিশ সমূলে উৎপাটন করে দিয়ে গেছে এখনকার আধা বিদেশি বুলি শেখা কেরানি তৈরির শিক্ষা।

জাপান যেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে প্রত্যেকটি মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে, আমাদের বিদেশি শাসকগণ সেখানে গণবিচ্ছিন্ন একটি তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত গোষ্ঠী তৈরির কাজে নেমেছিলো। এতদিনেও আমরা সেই আধা বিদেশি বুলি শেখা কেরানি তৈরির উচ্চশিক্ষার খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। শিক্ষা তাদের জীবনকে পূর্ণাঙ্গ করে গড়ে তোলার জন্য, আমাদের মতো আধাআধি করে নয়।

জাপানে প্রত্যেক শিশু পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। প্রায় প্রত্যেক অভিভাবকেরই ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, কিন্তু সেটা তারা সন্তানের সহপাঠীকে দেখাতে স্কুলে নিয়ে যায় না। জাপানে বিদ্যালয় হচ্ছে শিশুদের পরম আনন্দের জায়গা। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একত্রে বসে খাবার খায়। ফি বছর একখান করে চূড়ান্ত পরীক্ষার বালাই নেই। স্কুলে কোন শিশু অকৃতকার্য হয় না, যদি কেউ অকৃতকার্য হয় সে তার শিক্ষক, কেননা দায়িত্ব শিক্ষকের, সাফল্য শিশুর। জাপান যখন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে, আমাদের ব্রিটিশ-প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে কিছু কেরানি ও সুবিধাভোগী মানুষ তৈরিতে ব্যস্ত।

জাপানি সমাজ সৌন্দর্যের পূজারি। শৃঙ্খলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তাদের শিশুকালেই শিক্ষার মাধ্যমে রক্তের মাঝে গেঁথে দেয়া হয়। নৈতিকতা শিক্ষা জাপানের শিক্ষার আরেকটি মৌলিক দিক। সে নৈতিক শিক্ষা পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ। সে কারণে তাদের সমাজে পারস্পরিক ঘৃণা নেই, আছে প্রত্যেকের মনের মিল। ১৮৯০ সাল থেকে শিশুদের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩ ঘণ্টা করে নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। তাদের এ নৈতিক শিক্ষা গুটিকয় নীতিবাক্য শেখায় আবদ্ধ নয়। এ শিক্ষা অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, স্বাধীন চিন্তা ও আত্মনির্ভরশীলতা থেকে জীববৈচিত্র্যের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়া পর্যন্ত প্রসারিত। দক্ষতা অর্জনের চেয়েও প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিনয়-শিষ্টাচার, সৌন্দর্যবোধ ও নৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে আত্মিক বিকাশ লাভ জাপানে শিক্ষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

জাপান সম্পূর্ণই একটি পুঁজিবাদী দেশ, অন্যদিকে একাত্তরে বাংলাদেশের গায়ে একটু সমাজতন্ত্রের ঘ্রাণ লেগেছিল, যা জোরে নাক টানলে অল্পস্বল্প এখনও পাওয়া যায়। ওই দেশটি যদি তার শিক্ষাব্যবস্থাটিকে এতখানি সামাজিক বলতে গেলে সমাজতান্ত্রিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ব্যবসায়িক দোষটি আজও কাটানো যাচ্ছে না কেন?

 

লেখক : আলমগীর খান, সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028500556945801