বাংলাদেশের বিরোধিতা পর্ব ৪জামায়াত নিষিদ্ধে ঐতিহাসিক স্ববিরোধিতা

মিজানুর রহমান খান |

সংবিধান, আইন ও সংসদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক দুর্লভ নথি প্রকাশ করেছিলেন। এসব নিয়ে তার লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর অন্যতম হলো- ‘১৯৭১: আমেরিকার গোপন দলিল’। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক অজানা তথ্যের সম্ভার সাজিয়েছেন তিনি। নিয়েছেন অনেক এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার। প্রকাশ করেছেন অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। সেগুলোর কোনো কোনোটিতে  অবধারিতভাবেই উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা, গণহত্যা, আলবদর-আলশামস বাহিনীর অপতৎপরতা, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে ওই সব অপকর্মের পক্ষে নির্লজ্জভাবে জামায়াত নেতাদের সাফাই গাওয়ার গল্প। তেমনই কিছু নির্বাচিত লেখা ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে উপস্থাপনার অভিপ্রায়ে এই ধারাবাহিক আয়োজন।   

পাকিস্তানে একবার এবং ভারতে দুবার জামায়াত নির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধের স্বাদ পেয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী করেছিলেন আইয়ুবের ১১ বছর পর। বাংলাদেশ কখনো নির্দিষ্টভাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি। গোলাম আযমের মামলার রায়ে (নাগরিকত্ব মামলা) বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রকারান্তরে আক্ষেপ করেন এই বলে যে, এই ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করেছেন। শান্তি কমিটি সংগঠিত করেছেন। রাজাকারদের শিবিরে শিবিরে বক্তৃতা করেছেন। পাকিস্তানের শত্রুদের ‘খতম’ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ এর দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি।

বাংলাদেশে জামায়াত বিরোধিতার একটা ঐতিহাসিক স্ববিরোধিতা ও পলায়নপরতা আছে। আমাদের নেতাদের ঐতিহাসিক পলায়নপরতা আছে। ১৯৪৭ থেকে ভাষা ও স্বায়ত্তশাসন আমরা যত পরিষ্কারভাবে বুঝেছি এবং ধারণ করেছি, সেভাবে আমরা ধর্মের প্রশ্নে পারিনি। আমরা তাই প্রশ্ন তুলি, মুক্তিযুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা কোথায় ছিল? বাহাত্তরের সংবিধানে এটা এল কোথা থেকে?

১৯৫৬ সালের ইসলামি প্রজাতন্ত্র সংবিধানকে (জিন্নাহর সেক্যুলার আদর্শ নাকচ করে) মাওলানা আবুল আলা মওদুদি ‘জামায়াতের বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তখন তা নিয়ে পূর্ববঙ্গের উদারনৈতিক মুসলিম নেতাদের প্রকাশ্য রক্তক্ষরণ দেখি না। 

পাকিস্তান আমলে জামায়াতের গায়ে যুদ্ধাপরাধের কালিমা ছিল না। কিন্তু কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে দাঙ্গা বাঁধানো এবং সাম্প্রদায়িকতার নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। কাফের  ঘোষণার দাবিতে ১৯৫৩ সালে জামায়াত দাঙ্গা করেছে। ২০১৩ সালে এসেও তারা ‘শাহবাগি’দের নির্বিচারে নাস্তিক ঘোষণা করতে বলছে। দাঙ্গা ও রক্তপাত নিশ্চিত করছে। ওই দাঙ্গা সামরিক আইন এনেছে। পুলিশ ও সেনার গুলিতে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়। মওদুদি মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন। তখনকার মওদুদির সুর আর অসতর্ক খালেদা জিয়ার সুর যেন প্রায় একাকার হয়ে গেছে।

জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদি বিতর্কিত ইসলামি চিন্তাবিদ। বড় ভয়ংকর, ইসলামবিরুদ্ধ তাঁর দর্শন: হিন্দু-মুসলিম এক রাষ্ট্রে বাস করতে পারবে না।

ত্রিদেশীয় জামায়াতিদের গুরু মওদুদি। ৭২ বছর ধরে পাকিস্তানি ও বাঙালি জামায়াত একটি অসংজ্ঞায়িত ‘ইসলামি’ শাসনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারাও ‘কোরআন-সুন্নাহর আইন’ কী তা নির্দিষ্ট করেননি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম প্রশ্নে মানুষকে ধাঁধায় রেখেছে। ১৯৫৩ সালে যা অমীমাংসিত ছিল, সেটা আজও অমীমাংসিত। পাঞ্জাবের দাঙ্গার তদন্তে বিচারপতি মুনিরের নেতৃত্বে কমিশন হয়েছিল। এই কমিশনের অভিজ্ঞতা শুনুন: ‘ইসলাম কী এবং মোমিন বা মুসলিম কে, আমরা ওলামাদের কাছে জানতে চাইলাম। কিন্তু তাঁরা এই প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁরা জিন্নাহর রাষ্ট্রদর্শন প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি এক জামায়াতি সদস্য বলেন, তাঁর (জিন্নাহর) আদর্শের রাষ্ট্র হলো শয়তানের সৃষ্টি।’ মুনির কমিশন মওদুদির কাছে জানতে চেয়েছিল, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ হলে ভারতীয় মুসলিমদের কর্তব্য কী হবে? মওদুদি তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হওয়ার পরামর্শ দেন। বলেন, ‘পাকিস্তান বিরোধিতা তাদের উচিত হবে না।’

এই জামায়াত আইয়ুবের আমলে ২১ মাস নিষিদ্ধ থাকাকালে আমাদের পূর্বসূরিরা কী করেছিলেন? তখন বাংলাদেশে জামায়াতের ১৭টি অফিসে তালা মারা হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়তে তাদের বাধেনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সঙ্গে জামায়াতের বিরোধ সামরিক শাসনে অরুচর কারণে ঘটেনি। আইয়ুবের যুগান্তকারী ধর্মনিরপেক্ষ আইনগুলো তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল। ওই আইনেই প্রথম স্ত্রীর সম্মতিতে দ্বিতীয় বিয়ের শর্ত আরোপ করা হয়। জামায়াতি ফতোয়া ছিল, এটা ইসলামের প্রতি হামলা। বিরোধী রাজনীতিকেরা আইয়ুবের অপসারণে ওই সময়ে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি (কপ) করেছিলেন। 

আমরা এগুলো স্মরণ করছি আওয়ামী লীগকে খাটো কিংবা খোঁটা দেওয়ার জন্য নয়; আমরা আসলে কী এবং কতটা কী করতে পারি, সেটা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য। আয়নায় চেহারা দেখার জন্য।

১৯৬৪ সালে আমাদের তারকা ছাত্ররাজনীতিকদের একটি বিবৃতি দেখে কিছুক্ষণ থ হয়ে থাকলাম। আইয়ুবের জামায়াত নিষিদ্ধকরণ তাঁদের মতে ‘গণতন্ত্রের ওপর বর্বর হামলা’। ১৯৬৪ সালের ১০ জানুয়ারি ১৮ জন ছাত্রনেতা বলেন, ‘জামায়াতকে বেআইনি ঘোষণা দেশের বুক হইতে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা মুছিয়া ফেলিবার ষড়যন্ত্রের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।’ জামায়াতের নেতাদের মুক্তি দাবি করে তাঁরা ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার’ বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজকে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও জিএসের সই আগে। তাঁরা হলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী। আরও আছেন সেই সময়ের ছাত্রলীগের নেতা সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক।

গতকাল ফোন করি রাশেদ খান মেননকে। ‘আমি এই বিবৃতির কথা বিন্দুমাত্র স্মরণ করতে পারি না।’ মেননের উত্তর। হায়দার আকবর খান রনো বিবৃতিদাতাদের অন্যতম। স্মরণে আনতে তাঁরও কষ্ট হলো। তারপর বললেন, ‘আমরা তখন ছাত্র। আর জামায়াতের চেয়ে সামরিক জান্তা বেশি ঘৃণিত ছিল।’ এই নীতিহীন কৌশলগত যুক্তি আজও চলছে। স্বৈরশাসক এরশাদ যখন ‘বেশি ঘৃণিত’, তখনকার পক্ষ-বিপক্ষ আর আজকের পক্ষ-বিপক্ষ এক নয়। রনো ধন্যবাদার্হ্য। কারণ তিনি স্বীকার করেন যে সুবিধা অনুযায়ী রাজনীতি করার রোগ আমাদের আছে। জনাব মেনন অবশ্য এটুকু স্মরণ করেন যে ‘আইয়ুবের ওই আইনের বিরোধিতা আমরা চাইনি। কিন্তু নেতাদের কাছে আমাদের আপত্তি টেকেনি।’

স্ববিরোধিতার কফিনের শেষ পেরেক পঞ্চম সংশোধনীর রায়। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কখন কী বলেন, কখন কী পারেন আর কী পারেন না, তা বলা বড় মুশকিল। সরকারের দরকার পড়ল পঞ্চম সংশোধনীর রায়মতে একটি সংবিধান ছাপিয়ে নেওয়া। ব্যস, ‘বাঘা’ সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মত দিলেন। টাকশালে টাকা ছাপানোর মতো নতুন সংবিধান ছাপা হলো। সেখানে জামায়াতসহ সব ধর্মীয় দল নিষিদ্ধ হলো। কিন্তু তখন অন্য হিসাব, অন্য কৌশল। কী অদ্ভুত দেশ এবং তার দেউলিয়া রাজনীতি। সর্বোচ্চ আদালত জামায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। সংবিধান ছাপিয়ে তা কার্যকর আইনি রূপও দিল। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী তা স্বীকার করল না বলে সমাজে এর কোনো ছাপ পড়ল না। কোনো উচ্চবাচ্য হলো না। ১৫তম সংশোধনীতে তা নীরবে মুছে ফেলা হলো।

নির্বাচন কমিশন ও সরকারি নথিপত্রে পঞ্চম সংশোধনী মামলায় দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিন থেকে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সময়ে জামায়াতসহ ধর্মীয় নামযুক্ত কোনো দলের বৈধ অস্তিত্ব  থাকতে পারে না। সে হিসেবে এ দেশে সাংবিধানিক কারণে জামায়াত রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে দুবার। এবার তৃতীয়বারের পালা।

আসলে সুশাসন ও আইনের শাসন অভ্যাসগতভাবে প্রত্যাখ্যান করে চলা আমাদের শাসকগোষ্ঠী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সে কারণে তাদের কাজে-কর্মে ও অঙ্গীকারে অস্বচ্ছতার কোনো খামতি নেই। প্রচলিত আইনে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে তা টেকানো কঠিন মনে হয়। ভারত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে তা সুপ্রিম  কোর্টে টেকাতে পারেনি। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শেখার আছে।

চলবে


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036799907684326