জাল সনদধারী শিক্ষক ও এনটিআরসিএর দায়

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এমনিতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা কলঙ্ক  লেপটে আছে। নোট-গাইড ও কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস, স্কুল-কলেজে যৌন হয়রানি ইত্যাদি সারা দুনিয়ায় আমাদের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে। মাথা হেঁট করে রেখেছে। আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। সম্প্রতি জাল সনদধারী শিক্ষকদের ব্যাপারটি যুক্ত হওয়ায় শিক্ষার মানের বিষয়টি নতুন করে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। দেশের বহুল প্রচারিত শিক্ষা বিষয়ক ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম এবং একই পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা সর্বপ্রথম বিষয়টি জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছে। এটি নিঃসন্দেহে এক দুঃসাহসী কাজ। পত্রিকাগুলো কয়েক দফায় জাল সনদধারী শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশ করেছে এবং এখনো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে চলেছে। এ পর্যন্ত  ৯  পর্বে সহস্রাধিক জাল সনদধারী শিক্ষকের পরিচয় আমরা জানতে পেরেছি। এরা জাল সনদ নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। তাদের বেশিরভাগের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জাল। কারো কারো কম্পিউটার সনদ জাল। অন্য বিষয়েও জাল সনদ ধরা পড়েছে। জাল সনদে শিক্ষকতা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য নৈতিক অপরাধ। দেশ ও জাতির জন্য বিরাট কলঙ্ক। জন্মলগ্ন থেকে দৈনিক শিক্ষা ও দৈনিক আমাদের বার্তা শিক্ষার নানা ক্ষত অনুসন্ধানে আপসহীন ভুমিকা পালন করে আসছে। তাই, শিক্ষা ক্ষেত্রে এই দু'টি নাম এখন মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার বিশ্বস্ত ঠিকানা। কয়েক পর্বে জাল সনদধারীদের তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর এদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নেন,, তা এখন দেখার বিষয়।

শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় যারা জাল সনদ নিয়ে প্রবেশ করেছেন, তারা কী প্রকৃত মানুষ! এদের নীতি-নৈতিকতা বলে কী কিছুই নেই ? এরা শিক্ষকতায় কী করে এসেছেন ? এদের শিক্ষক হতে কারা সহযোগিতা করেছেন ? কাদের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন ? কাদের সাহায্যে এমপিওভুক্ত হয়েছেন ? জাল সনদ কোথা থেকে যোগাড় করেছেন ? এরা কি আর কোথাও চাকরি-বাকরি পেলেন না ? জাল সনদ নিয়ে শিক্ষকতায় না এসে অন্য পেশায় গেলেই তো পারতেন! শিক্ষায় এতো বড় কলঙ্ক যারা রচনা করেছেন, তারা ক্ষমার অযোগ্য । অন্য পেশায় টুকটাক দুই নম্বরি হতেই পারে।  শিক্ষকতায় দুই নম্বরি একদম মেনে নেয়া যায় না। এটি এক মহান স্বর্গীয় পেশা।  ইবাদত-সদৃশ কাজ। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ইহকাল ও পরকালে মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম মহান শিক্ষক। তাঁর প্রেরিত মহামানবরা প্রত্যেকেই শিক্ষক হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। এই মহৎ পেশাকে কলঙ্কিত করার অধিকার কারো নেই। যারা এসব করেন, তাদের মৃত্যুদন্ড কিংবা এর চেয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া উচিত। এ কথা সত্যি , এসব শিক্ষক নামধারী অপরাধীর কিছু হবে না। এরা শিক্ষকতায় ঠিকই থেকে যাবেন। তাদের সামান্য জেল-জরিমানাও হবে না। শিক্ষা প্রশাসনের লোকজনকে টাকা পয়সা খাইয়ে এরা বহাল তবিয়তে থেকে যাবেন। এদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দেশ ও জাতির ক্ষতি হবে। দেশ ও জাতির ক্ষতিতে প্রশাসনের লোকজনের কিছু যায় আসে না ! টাকা-পয়সা কামাই হলেই হলো। টাকা-পয়সা ছাড়া এরা অন্য কিছু বুঝেন না। কিছু চেনেনও না। নীতি, নৈতিকতা ও ধর্ম বলতে এদের কিছু নেই। এরাই প্রকৃত দোষী।সর্বাগ্রে এদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু, কে দেবে শাস্তি ? রাষ্ট্র ও সরকার এদের কাছে কেনো জানি অসহায়। এদের সিন্ডিকেট অনেক বেশি শক্তিশালী।

আমরা শিক্ষা জাতীয়করণের কথা বহুদিন থেকে বলে আসছি। কিন্তু, কে শোনে কার কথা ? ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে শিক্ষা জাতীয়করণ হওয়ার বিষয়ে শিক্ষকসমাজ অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, সরকার জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীকে স্মরণীয় ও মহিমান্বিত করতে ঐতিহাসিক মুজিববর্ষে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা না হউক অন্তত মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরটি জাতীয়করণ করবেন। সরকারের সেরকম আর্থিক সামর্থ্যও ছিলো। কিন্তু, করোনা মহামারি সবকিছু বিক্ষিপ্ত করে দিয়ে যায়। অধিকন্তু, আমলাদের জাতীয়করণ বিরোধী মনোভাবের কারণে সরকার সে পথে অগ্রসর হয়নি। ইদানিং শিক্ষক সমিতিগুলোও কেন জানি, জাতীয়করণের বিষয়ে একেবারে নীরব ভূমিকায় অবতীর্ণ। সরব হলেই বা তারা কী আর করতে পারবেন ? 'অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট'-তাঁদের এখন সেই অবস্থা। বেশিরভাগ শিক্ষক নেতা 'গাঁয়ে মানে না, আপনি মোড়ল'। শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ ও বিভাজন জাতীয়করণের পথে বড় অন্তরায়। শিক্ষা জাতীয়করণ হলে সনদ জাল করার মত অপকর্ম বন্ধ হয়ে যেতো। জাল সনদ নিয়ে কেউ শিক্ষকতায় আসতে পারতেন না। কেউ এদের সহযোগিতা করার সুযোগ পেতেন না। সাহসও  না। আমার বিশ্বাস, শিক্ষা প্রশাসনের লোকজনই শিক্ষা জাতীয়করণের নেপথ্যে শত্রু। এরা জাতীয়করণের সুফল সরকারকে দেখতে কিংবা বুঝতে দেন না। তাদের উপরি টাকা রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যাবে বলে। আজ পর্যন্ত সরকারি স্কুল-কলেজে জাল সনদ নিয়ে কেউ শিক্ষকতায় এসেছেন বলে শুনিনি। 

সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব বিষয়ে হেরফের করার সুযোগ কম। বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি করার অবারিত সুযোগ । আমলা-কামলারা এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকেন। আমার মনে হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি, গভর্নিং বডি এবং এনটিআরসিএ'র হাত ধরে এসব অনিয়ম হয়েছে।  কমিটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরা অনেকে লেখালেখি করে থাকি। কিন্তু তা উঠিয়ে দেয়া কিংবা এর সংস্কারে কারো  মাথাব্যথা নেই। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে কমিটির তেমন কোনো কাজ নেই। অথচ তাদের সভাপতিকে কমপক্ষে বি,এ পাস হতে হয়। সেখানে কমিটিতে একজন হাইস্কুল শিক্ষকও থাকেন। কিন্তু, হাই স্কুল বা কলেজে যেখানে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহ-প্রধান নিয়োগ সহ অন্যান্য অনেক ক্ষমতা কমিটির হাতে, সেখানে কমিটির সভাপতি থেকে শুরু করে বাইরের কোন সদস্যের লেখাপড়া না থাকলেও চলে। অনেক জায়গায় শিক্ষানুরাগী সদস্য পর্যন্ত ব-কলম লোকও মনোনীত হয়ে থাকেন। কী অদ্ভূত ব্যাপার !  

কিছুদিন থেকে শুনে আসছিলাম , এনটিআরসিএ বিলুপ্ত করে পিএসসি'র আদলে শিক্ষক নিয়োগ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এরকম কথাই বলা আছে। এখন আবার এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা নেওয়ার তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। জন্মের পর থেকে এই সংস্থাটি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছে । এরপরও এটি বিলুপ্ত করার উদ্যোগ নেই। যারা বিলুপ্ত করবেন, তারাও মনে হয় এখান থেকে টাকা-পয়সার ভাগ পান! 'চোরে চোরে মাসতুতো ভাই'-এই আর কি। এনটিআরসিএ'র দায়িত্ব শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা নেয়া পর্যন্ত সীমিত রাখলেই ভালো হতো। তাদের নামের মধ্যে নিবন্ধন (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) শব্দটি দেখতে পাই। কোথাও সুপারিশ শব্দটি নেই। নিয়োগের জন্য সুপারিশের ক্ষমতা পাওয়ায় তাদের এখন  সুবর্ণ সুযোগ। এখানে যারা কাজ করেন, তাদের কারো না কারো সহযোগিতায় জাল নিবন্ধন সার্টিফিকেট তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তা থেকে ড্রাইভার-পিয়ন পর্যন্ত নিশ্চয় কারো না কারো হাত আছে। তা না হলে এতো জাল নিবন্ধন সনদ কোথা থেকে আসে ? এরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে যায় না কেনো ? প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে তারা নাকি কিছু করতে পারছেন না। এটা কোনো কথা হলো ? 

স্কুল-কলেজে কমিটির দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। কমিটি ও এনটিআরসিএ'র মধ্যে কী সুন্দর কম্প্রোমাইজ ! প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকারি প্রধান ও কর্মচারীদের নিয়োগ কমিটি দিয়ে থাকে। সহকারি শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ দেয় এনটিআরসিএ। ভাগ করে খাওয়ার কী সুন্দর কৌশল ! উভয় জায়গায় টাকার খেলা। কোথাও কোথাও কমিটির লোকজন বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেন। ইদানিং ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট, অফিস সহায়ক, আয়া ইত্যাদি পদে নিয়োগ দিতে কমিটি লাখ টাকার ওপরে উৎকোচ নেন। নিয়োগ কমিটিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা পদাধিকার বলে  থাকেন। অনৈতিক কাজে তারাও কম যান না। দুই এক জায়গায় ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যারা টাকা-পয়সা লেনদেনের ধান্ধায় থাকে, তাদের ভালো করে সনদ যাচাই করে দেখার সময় কোথায় ? কোনো কোনো সময় এরাই যোগ্যতাহীন টাকাওয়ালা প্রার্থীদের কোনমতে একটা সনদ যোগাড়ের পরামর্শ দিয়ে পথ দেখিয়ে দেন। 

প্রাথমিক শিক্ষা স্তরটি সরকারি হওয়ার কারণে  উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীরা আগ্রহ নিয়ে এখানে শিক্ষকতায় আসছেন। আজ থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে গ্রামাঞ্চলের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে এক-দু'জন মাত্র শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের বেশিরভাগের শিক্ষাগত যোগ্যতা নন ম্যাট্রিক ছিলো। আজ সে জায়গায় প্রতিটি স্কুলে আট-দশজন করে শিক্ষক। কোথাও কোথাও আরো বেশি। তাঁদের বেশিরভাগ অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। রেজাল্টও বেশ ভালো। জাল সনদ নিয়ে শিক্ষকতায় আসার সুযোগ নেই। এই সব মেধাবী শিক্ষকের কারণে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরটি এখন শক্ত একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে। প্রাথমিক শিক্ষার অনুসরণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণ করা হলে আমাদের শিক্ষায় সুদিন আসতে বেশি দেরি হবে না। তা না হলে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় জাল সনদধারীদের অনুপ্রবেশ দিন দিন আরো বাড়তে থাকবে। এমনি করে কমিটি, এনটিআরসিএ এবং শিক্ষা প্রশাসনের লোকজনের সহায়তায় জাল সনদধারীরা শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে একদিন গ্রাস করে  ফেলবে !

লেখক : আবাসিক সম্পাদক (লন্ডন), দৈনিক শিক্ষাডটকম


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033671855926514