জিপিএ-৫ ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও |

শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা একটি প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। অর্থাত্ একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীরা অসংখ্য প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসার উত্তর অন্বেষণের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করে তোলে। এজন্য দেখা যায় ইংল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের মেধা অনুসারে বিভিন্ন গ্রেডে বিভক্ত করে তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা হয়। এবং সেরা মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি বা শিক্ষাব্যয় থেকে অব্যহতি দিয়ে তাদের জ্ঞানান্বেষণের প্রতি আগ্রহী করে তোলা হয়। এই দিক থেকে একটি মহত্ উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকারও প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করেছে, যার সর্বোচ্চ মান নির্ধারণ করা হয়েছে জিপিএ-৫।

কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের একটি সহজাত প্রবণতা হলো—আমরা সবাই যেকোনো উপায়ে প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে চাই। আর তাই দেখা যায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তির প্রতিযোগিতাই যেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একমাত্র ও প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তির এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। প্রতিযোগিতাটিকে অসুস্থ বলছি কারণ, সাম্প্রতিককালে এই যে প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা ঘটছে, আর সেই প্রশ্নের পেছনে অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা কাড়ি কাড়ি অর্থ নিয়ে অবিরাম ছুটে চলছে—তার পশ্চাতে নিহিত রয়েছে ভালো ফল তৈরি করার প্রবণতা। শুধু তাই নয়, এ-প্লাস বা গোল্ডেন এ-প্লাস নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তারা দ্বারস্থ হচ্ছে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলোতে। আর এই সুযোগে কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে ফল-কেন্দ্রিক নির্দিষ্ট কিছু পাঠদানে সহায়তা করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়েনি। অর্থাত্ বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানান্বেষণের প্রতিযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে তা তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না।

আবার দেখা যায় সামাজিকভাবেও আমরা জিপিএ-৫ বা ফলাফল-কেন্দ্রিক শিক্ষাকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নির্ণয় করছি ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে জিপিএ-৫ এর ওপর এত বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে যে, শিক্ষার্থীরা ফলাফল কেন্দ্রিক পড়ালেখাকে অধিকমাত্রায় গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাত্ বলা যায় সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফলাফল কেন্দ্রিক পড়ালেখার প্রতি আমরা শিক্ষার্থীদের এক প্রকার বাধ্য করছি।

আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ভালো ফল তৈরির আশায় কোচিং সেন্টারগুলোর ওপর যে একাগ্রচিত্তে আস্থা রাখছে, তার দায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে কেবল ফলাফল-কেন্দ্রিক শিক্ষাদান করে থাকে। এবং অনেক ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে যথাযথ পাঠদান করতে পারছে না বা পাঠদান করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মনে রাখতে হবে, শিক্ষা কোনো বাণিজ্যের বিষয় নয় এবং কেবল শিক্ষার্থীদের ফল তৈরিতে সহায়তা করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য নয়। শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশ ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধ সম্বলিত একজন শিক্ষিত মানুষ তৈরি করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

এজন্য তাদের পাঠদানের পাশাপাশি খেলাধুলা, শিক্ষাসফরের আয়োজন ও বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি মাসে বিষয়ভিত্তিত কুইজ পরীক্ষার আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অনুসন্ধানে ব্যাপৃত রাখাসহ শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একইসাথে শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে কিনা, তারা পাঠদান প্রক্রিয়াকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে, যেমন স্বগৃহ কিংবা কোচিং সেন্টারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না—সে বিষয়ে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। অভিভাবক-শিক্ষার্থীদেরও উপলব্ধি করতে হবে যে, ফলনির্ভর শিক্ষায় সাময়িকভাবে সফলতা অর্জন করা গেলও তা কখনোই শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে সহায়তা করবে না।

মনে রাখতে হবে নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ আর মেধার বিকাশ ঘটানোই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। সেখানে ফলাফল তৈরি, জ্ঞানান্বেষণের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা সৃষ্টির উপায় মাত্র। তাই একজন শিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র ফলাফলের ওপর মূল্যায়ন করলে চলবে না। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক ভর্তির সুযোগদানের যে প্রবণতা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাগ্রহণ একটি মানসিক প্রক্রিয়া, এখানে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া বা আরোপ করার অর্থই হলো শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করা। তাই শিক্ষার্থীরা যেন আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা অর্জন করতে পারে—তা পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক :অধ্যক্ষ, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022130012512207