জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়!

উমর ফারুক |

‘উচ্চশিক্ষা অধিকার না পণ্য’-এ বিতর্ক বেশ পুরনো ও লম্বা। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পূর্বশর্ত মেধা। মেধাহীন মানুষের মাঝে উচ্চশিক্ষা বিতরণ অর্থের অপচয় মাত্র। যদিও কেউ কেউ উচ্চশিক্ষাকে অর্থ ও মেধা উভয় মাপকাঠিতে মাপতে আগ্রহী। বিতর্কের ফলাফল যাই হোক, উচ্চশিক্ষা যে মানসম্পন্ন হতে হবে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষা অধিকার কিংবা পণ্য যাই হোক না কেন, মানহীন উচ্চশিক্ষা বিতরণ নিম্নশিক্ষা বিতরণের নামান্তর। উচ্চশিক্ষা কী? উচ্চশিক্ষা বিতরণ ও গ্রহণের শর্ত কী? বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় খুব একটা পরিষ্কার নয়।

শিক্ষা নিঃসন্দেহে অধিকার; কিন্তু উচ্চশিক্ষাকে অধিকার ভাবলে শিক্ষায় অপচয় বাড়ে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য কর্মসংস্থান আর শিক্ষা সূচনার মূল লক্ষ্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা সমাপনী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও বিতরণের প্রবল আগ্রহ আমাদের শিক্ষার মানকে ব্যাপকভাবে বিনষ্ট করছে।

রাঙামাটিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেদিন স্থানীয় একজন সরকারি আমলা তার শিক্ষা কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন। চিন্তার কত ক্ষুদ্র পরিসর! কোনো ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে, কোনো অবকাঠামো বির্নির্মাণ না করে, কোনো শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিত না করে, কেবল স্থানীয় উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চলতে শুরু করেছে একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ হলো বিশ্বমানের সার্বজনীন শিক্ষালয়। স্থানীয় উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুব একটা শোভন শোনায় না।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত সূচনা বলে দেয়, আমাদের উচ্চশিক্ষা হাল কতটা বিপর্যস্ত! কতটা বিপথে আছে আমাদের উচ্চশিক্ষা। কতটা বিপদে আছে আমাদের গবেষণা শিক্ষা ব্যবস্থা। সম্প্রতি এবং অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিক্ষার প্রয়োজনে, আর কিছু রাজনৈতিক বিবেচনায়। কোনো অবকাঠামো নেই, কোনো শিক্ষাসুবিধা নেই। কিন্তু সেগুলো একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব ভবন নেই। প্রাথমিক বিশ্ববিদ্যালেয়ের নূ্যনতম সুযোগ-সুবিধাও নেই; কিন্তু নামে সেগুলো একেকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবাসন সুবিধা নেই, পরিবহন সুবিধা নেই, গ্রন্থাগার ও গবেষণা সুবিধা নেই। কিন্তু সেগুলো উচ্চ ও গবেষণা সনদ বিতরণ করছে।

দেশে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কিছুটা রাজনৈতিক আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য অনেকাংশে বাণিজ্যিক? কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের ভাবতে হবে, কোথায় আছে আমাদের উচ্চশিক্ষার মান? কোথায় নিতে চাই আমাদের উচ্চশিক্ষাকে? আমাদের প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের সঙ্গে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানের পার্থক্য কতটুকু? আর কতটা পথ হাঁটলে শিক্ষাবৈষম্য কমবে? এ কথা সত্য, শিশু-বিশ্ববিদ্যালয় ও বয়স্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু সেই পার্থক্যটা কতটুকু? সেই ব্যবধান কি সীমাহীন?

শিক্ষামানের প্রতিযোগিতা ও প্রান্তিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিশদ ভাবনা প্রত্যাশিত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার একটি বিশেষত্ব আছে। শুনতে খারাপ লাগলেও এ কথা সত্য, উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। উচ্চশিক্ষা যথাযথ বিতরণ কিংবা মানহীন বিতরণ অত্যন্ত হতাশাজনক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় নয়। হোক প্রাইভেট কিংবা পাবলিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা পরিবেশের মান নিয়ে কোনো আপস নয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নূ্যনতম সুবিধা নিশ্চিত না করে, মূল্যায়ন ছাড়া গাণিতিক হারে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার মানকে কমিয়ে দিতে পারে। বিভিন্ন জনসভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে আমরা তার প্রতিফলনও দেখতে পাচ্ছি। একটি ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু বিদ্যমান পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান না বাড়িয়ে কিংবা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তুলনামূলক মানে উন্নীত না করে, শুধু নির্বাচনী ইশতেহার পূরণে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ভয়াবহ শিক্ষা দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে। ভোটের পাল্লায় উচ্চশিক্ষা বিতরণ দূষিত করতে পারে শিক্ষামানকে।

আমাদের বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণানির্ভর করতে হবে। গবেষণা-বরাদ্দ বাড়াতে হবে। উচ্চশিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে। একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নূ্যনতম সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা উপকরণ ও গবেষণা সুবিধা নিশ্চিত না করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অবশ্যই একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত।

প্রতিটি জেলায়, উপজেলায় অবশ্যই উচ্চশিক্ষা পৌঁছে দিতে হবে। সম্ভব হলে আরও প্রান্তিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু মান নিয়ে কোনো আপস নয়। তাই জেলায় জেলায় অপরিকল্পিতভাবে, রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কোনো সুখবর নয়। খারাপ খবর। আমাদের শিক্ষার মান আজ বিতর্কিত। আমাদের নিম্ন শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা আজ বিতর্কিত। এ রকম এক মহাসংকটে আমরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে উদাসীন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমাদের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে এবং যতক্ষণ তা করা না যাচ্ছে ততক্ষণ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। যদি আমরা মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা বিতরণে যোগ্য না হয়ে থাকি, তাহলে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।

লেখখ: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023558139801025