জ্ঞান ও শক্তির সমীকরণ

জাহিদুল ইসলাম |

‘জ্ঞানই শক্তি’ কথাটি আমরা সবাই বলে থাকি। জ্ঞান যদি শক্তি হয় তবে সে জ্ঞানের কি কোনো পরম সত্য রূপ আছে? যদি থেকে থাকে তবে তা কী? সম্ভবত একদল মানুষ মিলিত হয়ে কোনো কিছুকে সত্য বলে মেনে নেওয়া। এ মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় সম্মতি উত্পাদন করা হয়। সত্য কি স্থির-চিরন্তন-পরম, না,তা পরিবর্তনশীল এবং আপেক্ষিক? সমাজচিন্তক, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ সম্মতি অর্জনের জন্য যে সকল যুক্তি উত্থাপন করেন তা কতটা যুক্তিনির্ভর ও সত্য?

উপনিবেশ যুগের শুরুতে ইউরোপ সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য এই সত্য প্রতিষ্ঠা করল যে, ইউরোপ হচ্ছে উন্নত ও সভ্য, অবশিষ্ট দেশ হচ্ছে অনুন্নত ও অসভ্য। ইউরোপিয়ানরা শাসক, অন্যরা শাসিত। ইউরোপের কাজ হচ্ছে এসব অসভ্যদের শিক্ষক হিসাবে তাদের সভ্য করে গড়ে তোলা। এমে সেজায়ারের মতে এ সভ্য করার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইউরোপ বিভিন্ন সময় নাত্সীদের অনুসৃত নীতি তার অধীন দেশে প্রয়োগ করে। এসব কৌশলের উদ্দেশ ছিল বিজিত জনগোষ্ঠীকে হীনবল করে রাখা এবং উপনিবেশ শাসনের সাফল্য ও স্থায়িত্ব বজায় রাখা। ফ্রানত্স ফানোর মতে, উপনিবেশিক শাসনের ফলে শাসক ও শাসিত উভয়ের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে। ঔপনিবেশিক শক্তির কৌশলের মাধ্যমে স্থানীয়দের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-ভাষা ক্ষয় হতে হতে একসময় বিলীন হয়ে যায়। উপনিবেশ শাসিত রাষ্ট্রগুলো তাদের প্রভুর সেবাদাসে পরিণত হয়। প্রভুর ইচ্ছা অনুসারে চলতে হতো দাসকে, তাদের নিজেদের চিন্তা বলতে কিছু ছিল না। অন্যদিকে ঔপনিবেশ শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য শাসকরা নিজেদের মতো আইন ব্যবস্থা, কারাগার, পুলিশবাহিনী গড়ে তোলে। যাদের কাজ ছিল প্রতিবাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া। অনেকটা মিশেল ফুকোর শরীরী রাজনীতির মত। ফুকোর মতে আধিপত্য টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই এসব আইন, কারাগার, পুলিশবাহিনীর সৃষ্টি।

আঠার শতকের শুরুর দিকে ফ্রান্সে অভিজাতদের ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার কারণে রাজার পক্ষে দার্শনিকদের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। এজন্য তারা বিভিন্ন দার্শনিকদের ভাড়া করে। সেই ভাড়াটে দার্শনিকরা জ্ঞাতে- অজ্ঞাতে বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে প্রচার করেন। রাজপোষকতার মাধ্যমে ভলতেয়ারের মত দার্শনিক ‘বিশ্বকোষ’ লেখেন। যার মাধ্যমে তিনি রাজশক্তির শত্রু সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণিকে আক্রমণ করেন। ভলতেয়ার মোটেই বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু এটা সত্য যে, তার লেখা ফরাসি বিপ্লবের পক্ষে কাজ করেছিল। তার অঙ্গীকার ছিল মানুষকে মুক্ত করা। ভলতেয়ার বিশ্বাস করতেন মানুষে মানুষে সাম্য খুবই জরুরি। ১৭৩৪ সালে তার ‘Letters Philosophiques’ নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তার এই অসামান্য গ্রন্থে অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিক চিন্তা বিধৃত হয়; মনের বিশিষ্ট প্রকৃতির সংজ্ঞাও তিনি এতে নির্দেশ করেন। এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর ভলতেয়ারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। এর ফলে তাকে দীর্ঘ ২৮ বছর দেশান্তরিত হতে হয়। ফরাসি বিপ্লবের আরেক অগ্রদূত ছিলেন রুশো। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা দার্শনিক। সামাজিক চুক্তি মতবাদের ফলে রাষ্ট্রের উদ্ভব, সুতরাং রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের ইচ্ছার মধ্যে নিহিত। রাজার দৈব অধিকার একটি ভ্রান্ত ধারণা, এটাই ছিল তার ‘দ্য সোশাল কন্ট্রাক্ট’ -এর প্রতিপাদ্য বিষয়। এ বইটি লেখার ফলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। তখন থেকে তিনি ছদ্মনামে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাটান। তখনকার সময় দার্শনিকদের চিন্তার গ্রহণযোগ্য সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সীমা অতিক্রম করলে নেমে আসত নির্যাতন-জেল-জুলুম। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আদিম, বন্য জিঘাংসা দেখে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন। পত্রিকায় যুদ্ধবিরোধী প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তিনি কেমব্রিজের চাকরি হারান এবং জরিমানাও দিতে হয়। পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব বাংলায় শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক দার্শনিক, শিল্পী, সাহিত্যিকদের চিন্তাকে অবদমন করে রাখা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আহমদ ছফার মতে- আইয়ুব খানের শাসনামলে লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহসিকতা প্রদর্শন করেন বদরুদ্দীন উমর। ছফা বলেন- ‘উমরের প্রতিটি বই গণচিত্তে অ্যাসিডের মত কাজ করেছে। অ্যাসিড যেমন করে খাদ খেয়ে খাঁটি উজ্জ্বল করে তোলে, উমরের বইও ধাক্কা দিয়ে মানুষের অধিকারের দাবিতে সংগ্রামী বৃত্তিগুলো জাগিয়ে তোলে।’ বদরুদ্দীন উমরের ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ লেখার পর তাঁর কাছে প্রস্তাব আসে হয়ত তিনি তাঁর বইগুলো বাজার থেকে তুলে নেবেন অথবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত বদরুদ্দীন উমর নিজের আদর্শের কাছে হার মানেন এবং চাকরি ছেড়ে দেন। (আহমদ ছফা, জাগ্রত বাংলাদেশ, পৃ: ৫৬-৫৭)

মূলত প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার মাধ্যমে প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া যায় ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। এবং তখনই জ্ঞান পরিণত হয় শক্তিতে।

 

লেখক :শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস - dainik shiksha কাল খুলছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শনিবারও চালু ক্লাস সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাজ চলছে: শিক্ষামন্ত্রী বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি - dainik shiksha বিএসসি মর্যাদার দাবিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের মাসব্যাপী কর্মসূচি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় - dainik shiksha ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে স্মার্টফোন নয় একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব - dainik shiksha একই স্কুলের দুই ছাত্রীকে বিয়ের পর আরেক ছাত্রীকে ল্যাব সহকারীর অনৈতিক প্রস্তাব দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023281574249268