টাকার গরমে শিক্ষকতা ছাড়েন মতিউরের প্রথম স্ত্রী

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

ঘুষখোর স্বামীর অবৈধ টাকার গরমে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপকের চাকরি ছেড়েছিলেন লায়লা কানিজ লাকী। ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে তখন কানাঘুষা চলছিলো লাকীকে নিয়ে। চাকরি ছাড়ার সময় তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। তার স্বামী ছাগলকাণ্ডে আলোচিত সমালোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান। লায়লার বাবা ও নানাবাড়ীর সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। লায়লার নানা ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার। অপরদিকে রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের বাবাও বিএনপির স্থানীয় নেতা ও এমপিওভুক্ত শিক্ষক ছিলেন। লাকী ছাগলকান্ডে আলোচিত মতিউরের প্রথম স্ত্রী। বর্তমানে লাকী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি এলাকায় নব্য আওয়ামী লীগার হিসেবে পরিচিত। তার নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ।

সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক হয়ে কীভাবে তিনি এত সম্পদের মালিক বনে গেলেন-এ নিয়ে নানা প্রশ্ন জনমনে। এলাকাবাসী বলছেন, রাজাকার ও বিএনপি পরিবারের সন্তান হয়ে কানিজ কীভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন এবং এত সম্পদের মালিক বনে যান। এলাকায় কেউ তার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না। লায়লা কানিজের নামে-বেনামে রয়েছে প্রচুর সম্পদ। গত ১৫ বছরে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। শুধু রায়পুরাতেই নয়, তার সম্পদ ছড়িয়ে রয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

আরো পড়ুন: 

ছাগলকাণ্ড: এনবিআর থেকে সরিয়ে দেয়া হলো মতিউরকে

সোনালী ব্যাংকের পদও হারাচ্ছেন ছাগলকাণ্ডের মতিউর

লায়লা কানিজের নির্বাচনি হলফনামা থেকে জানা গেছে, তার বার্ষিক আয় বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা, কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ টাকা, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা, উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানি বাবদ ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫ টাকা এবং ব্যাংক সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫লাখ টাকা। তার কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ, তার অকৃষিজমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠা, সাভারে সাড়ে আট কাঠা, গাজীপুরে পাঁচ কাঠা, গাজীপুরের পূবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, গাজীপুরের খিলগাঁওয়ে ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমান বর্তমানে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে পালন করছেন। তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর ঘরে তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও ফারজানা রহমান ইপসিতা নামের দুই সন্তান রয়েছে। অন্যদিকে 'ছাগল-কাণ্ডে' আলোচিত সেই তরুণ মুশফিকুর রহমান (ইফাত) মতিউর রহমানের দ্বিতীয় সংসারের প্রথম সন্তান। মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী ফেনীর সোনাগাজীর এলাকার শাম্মী আখতার।

জানা গেছে, লাকী ছিলেন রাজধানীর তিতুমির সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। শিক্ষকতার পাশাপাশি রায়পুরা উপজেলার মরজালে নিজ এলাকায় প্রায় দেড়শত একর জমিতে ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট নামের একটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলেন তিনি। ২০২৩ সালে রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সাদেকের মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন লায়লা কানিজ লাকী। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির তিনি দুর্যোগ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মতিউর রহমান ও লায়লা কানিজ দম্পতির আধুনিক স্থাপত্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি।

গতকাল শনিবার সাংবাদিকরা সেখানে গেলে তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেননি বাড়ির কেয়ারটেকার। বলেছেন, 'উপজেলা চেয়ারম্যান এখন বাড়িতে নেই।' তবে ফটকের বাইরে থেকে দেখা যায়, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের বাড়িটি বেশ বিলাসবহুল। আলিশান বাড়ির আলিশান গেট। বাড়ির ভেতরে রয়েছে দেশি-বিদেশি সারি সারি গাছ, সবুজ ঘাসের আঙিনা, পাশে রয়েছে কর্মচারীদের থাকার রুম। বাড়ির পেছনে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও বিশাল লেক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, বাড়িটির ভেতরে রাজকীয় সব আসবাবপত্র ও দামি জিনিসপত্র রয়েছে। এ বাড়িতেই চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ থাকেন। এটা তার পৈতৃক সম্পত্তি। আগে সেখানে তেমন ভালো কোনো দালান ছিল না। প্রায় দুই বছর ঐ জমিতে এই বিলাসবহুল বাড়িটি নির্মাণ করেন লায়লা কানিজ।

ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্টে গিয়ে দেখা গেছে, ১৫০ একরের বেশি আয়তনের এই পার্কে রয়েছে বিলাসবহুল একাধিক কটেজ। নির্ধারিত টাকায় এ কটেজে রাত যাপন করা যায় বলে জানান পার্কের এক কর্মচারী। পার্কে রয়েছে বিভিন্ন বয়সিদের জন্য বেশকিছু রাইড। পুরো পার্ক জুড়ে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা রয়েছে, আছে বিশাল একটি লেকও।

স্থানীয়রা বলছেন, লায়লা কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন তৎকালীন আমলে একজন খাদ্য কর্মকর্তা। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে লায়লা কানিজ সবার বড়। সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করলেও রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ের পর তার ভাগ্য খুলে যায়। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। আগে লাকীদের আর্থিক অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। জানা যায়, লায়লা কানিজ লাকী একজন রাজাকারের নাতনি। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কানিজের নানা আব্দুল কাদির চেয়ারম্যান (মরজাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান) ছিলেন রাজাকারদের সংগঠন শান্তি কমিটির সদস্য। উপরন্তু তিনি ছিলেন এলাকার চিহ্নিত রাজাকার ময়দর আলী দারোগার মেয়ের জামাই। এছাড়া লায়লা কানিজ বিএনপি পরিবারের সন্তান । তার চাচা এবং মামারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

লায়লা কানিজ সম্পর্কে বিমান বাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, 'সরকারি চাকরি করে এত টাকার মালিক তিনি কীভাবে হলেন-এটা আমার বোধগম্য নয়। তিনি আমার জমিসহ অনেকের জমি দখল করেছে। জমি ক্রয় করার কথা বলে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে জমি দখলে নেয়। বাকি টাকা প্রদানের পর রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে বলে কথা থাকলেও তিনি আর কোনো টাকা দেননি। জোর করে জমি দখলে নিয়ে ঢালাই করে পার্কের জন্য ব্যবহার করছেন। আমি জমির কোনো দলিল করে দেইনি, জোরপূর্বক আমার জমি দখল করে রেখেছে। এছাড়া তিনি প্রশাসনিকভাবে তাকে হয়রানি করছেন এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। আমি একজন দরিদ্র মানুষ, আমার তেমন টাকা পয়সা নেই, তার অনেক টাকা-পয়সা, তার বিরুদ্ধে আমি আর কী করতে পারি। এভাবেই আছি, আল্লাহ যদি কোনোদিন তার বিচার করেন।'

লায়লা কানিজ সম্পর্কে মরজাল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সানজিন্দা সুলতানা নাসিমা বলেন, 'উনি সরকারি চাকরি করেছেন, একজন সম্মানিত শিক্ষক ছিলেন। তার এত সম্পদের মালিক হওয়া নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া তিনি আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য না। উনি একজন রাজাকারের নাতনি। ওনার বাবার বাড়ি, নানার বাড়ির সবাই বিএনপি করেন। বিএনপি থেকে উনি নব্য আওয়ামী লীগার সেজেছেন। রায়পুরা উপজেলায় আওয়ামী লীগটাকে ভাগ করে দিয়েছেন। তছনছ করে দিয়েছেন পুরো উপজেলাকে।' রায়পুরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, 'ময়দর আলী দারোগা ছিল তৎকালের চিহ্নিত রাজাকার। এটা সবাই জানে।'


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এইচএসসি পরীক্ষার দিন বৃষ্টি হলে সময় বাড়ানোর নির্দেশ - dainik shiksha এইচএসসি পরীক্ষার দিন বৃষ্টি হলে সময় বাড়ানোর নির্দেশ প্রথম দিনে বহিষ্কার ২৪, অনুপস্থিত ১৩ হাজার - dainik shiksha প্রথম দিনে বহিষ্কার ২৪, অনুপস্থিত ১৩ হাজার ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত’ - dainik shiksha ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত’ কাল থেকে ঢাবিতে পরীক্ষা বর্জনসহ সর্বাত্মক কর্মবিরতি - dainik shiksha কাল থেকে ঢাবিতে পরীক্ষা বর্জনসহ সর্বাত্মক কর্মবিরতি পা দিয়ে লিখে আলিম পরীক্ষা দিচ্ছে রাসেল - dainik shiksha পা দিয়ে লিখে আলিম পরীক্ষা দিচ্ছে রাসেল এমপিওভুক্তির জন্য টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয় - dainik shiksha এমপিওভুক্তির জন্য টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয় শিক্ষাসচিব ও মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে একি বললেন অধ্যক্ষ! - dainik shiksha শিক্ষাসচিব ও মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে একি বললেন অধ্যক্ষ! কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে আহমদ ছফার বইয়ে ছফার প্রচ্ছদই নেই - dainik shiksha আহমদ ছফার বইয়ে ছফার প্রচ্ছদই নেই দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002612829208374