ইদানীং ছাত্রসংসদ নির্বাচনের উপলব্ধি নতুনভাবে শুরু হয়েছে। কয়েক বছর ধরে ছাত্ররাজনীতির অধঃপতন থেকে এই উপলব্ধিটা বেড়েছে। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ছাত্রসংসদ নির্বাচনের সাক্ষী হতে না পারলেও এই আলোচনার সাক্ষী হতে পেরেছে। গত বছর ৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ডাকসু ইজ আ মাস্ট।’ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের ঘোষণার প্রায় দেড় বছর পর ডাকসু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে চলেছে। আগামী বছরের মার্চ মাসে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডাকসুর এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে অন্যান্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমরা প্রায়ই লক্ষ করেছি, রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অত্যন্ত প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে বাস্তবতার নিরিখে ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ছাত্ররাজনীতির শুদ্ধ চর্চার বিষয়ে কথা বলে থাকেন।
সংগত কারণেই আমরা ধরে নিচ্ছি, আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বক্তব্যে রাবি ছাত্রসংসদ তথা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (রাকসু) নির্বাচন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। উল্লেখ্য, রাবির বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তাঁর দিক থেকে রাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছিলেন। সেই সুবাদে আমরা ভাবছি, ডাকসু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রাকসু নির্বাচনের ইস্যুটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলবে। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা দেশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি রাষ্ট্রপতির সমাবর্তনে দেওয়া বক্তব্যে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও দৃঢ় নির্দেশনা আসে, তাহলে ডাকসুর মতো রাকসু নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা ঘোষণাও সহজ হয়ে উঠবে।
দীর্ঘদিন রাকসু নির্বাচন না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই জানেন না যে রাকসু কী এবং কেন। এমনকি রাকসু ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথায় অবস্থিত সেটিও অনেকে জানেন না। অনেকের কাছে রাকসু ভবনটি সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। কারণ রাকসুর নিজস্ব কার্যক্রমের পরিবর্তে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ওই ভবনটিতে কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় রাকসু ফি বাবদ একটি নির্দিষ্ট টাকা পরিশোধ করলেও এর যথাযথ সুফল তাঁরা কখনোই পাচ্ছেন না। অথচ সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের এই সংগঠনের অনেক তাৎপর্য রয়েছে।
এ কথা স্বীকার্য যে একসময় ছাত্ররাজনীতি বড় বড় রাজনৈতিক নেতা তৈরির সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু এখন ওই অর্থে আর হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এর অন্যতম কারণ ছাত্রসংসদ না থাকা, নির্বাচন না থাকা। এমনকি যথাযথ প্রতিনিধিত্ব গড়ে না ওঠা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, পরবর্তীকালের তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি আর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতা তৈরি করতে পারছে না বললেই চলে। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষমতার আধিপত্য, বড়াই-লড়াই, হল দখল, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাটুকারিতা, পকেট নেতা তৈরি, প্রশাসনের অন্যায্য সমর্থন প্রভৃতি কারণে ছাত্ররাজনীতির যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না।
ছাত্রসংগঠনগুলোর কমিটি গঠন ও শাখা গঠনের জন্য এখন যোগ্যতার পাশাপাশি চলে লাখ লাখ টাকার রাজনৈতিক বাণিজ্য। এই অপরাজনীতির দাপটে ক্রমেই ছাত্ররাজনীতি হয়ে উঠছে অসৎ ও অশুভ। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ছাত্রদের ওপর। নেতা নির্বাচনে যেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতের কোনো মূল্য নেই, সেহেতু অপতৎপরতা বন্ধ হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। আর এ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের ন্যায্য দাবি কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কোনো কোনো সময়ে তাঁদের (সাধারণ শিক্ষার্থী) ওপর জুলুম-অত্যাচারও চলে। এসব কারণে বর্তমান সময়ে মেধাবীরা ছাত্ররাজনীতি পরিহার করছেন। ফলে ক্রমেই মেধাশূন্য হয়ে উঠছে ছাত্ররাজনীতি।
যখন ছাত্রসংসদ নির্বাচন হতো তখন ঠিকই ভালো ছাত্রনেতা তৈরি হয়েছে। আর এই উপলব্ধি থেকেই সাম্প্রতিককালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। আমি বিশ্বাস করি, ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলেই ছাত্ররাজনীতি কলুষমুক্ত হবে। এখনকার ছাত্রনেতারা রাজনীতির নামে যে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলে সেই অপব্যবহারের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে। কারণ নির্বাচনে সাধারণ ছাত্রদের ভোটে বিজয়ী হওয়ার প্রশ্ন থাকবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ১৯৮৯-৯০ মেয়াদকালে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হওয়ার পর প্রায় তিন দশক ধরে বন্ধ রয়েছে রাকসু নির্বাচন। অবশ্য ২০১৭ সালের ১৬ মে রাকসু নির্বাচনসহ আরো ২৪ দফা দাবিতে বর্তমান উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন ছাত্রলীগের নেতারা। এটি একটি ইতিবাচক প্রবণতা। কারণ সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন যখন নিজেরাই ছাত্রসংসদ নির্বাচন চায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের এই আয়োজনটা করার ক্ষেত্রে খুব বেশি বেগ পাওয়ার কথা নয়।
১৯৬২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের গঠনতন্ত্র অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই গঠনতন্ত্রে উল্লেখ ছিল, ‘বাস্তব জীবনে কর্মদক্ষতা, যোগ্য নাগরিক ও নেতৃত্ব গড়ে তুলতে দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও অনুমোদিত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া, বক্তৃতা, লিখন, বিতর্ক ইত্যাদিতে তাঁদের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করার জন্য শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করতে কাজ করবে রাকসু।’ এ ছাড়া মানবিক-সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের আয়োজনও ছিল রাকসুর কর্মসূচিতে। কিন্তু রাকসু নির্বাচন দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকায় সংগঠনের এসব কার্যক্রম আর লক্ষ করা যায় না। ফলে ক্যাম্পাসে গড়ে উঠছে অসুস্থ ছাত্ররাজনীতির প্রতিযোগিতা। এমন ধারণা সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে মাঝেমধ্যেই দেখা দেয় হানাহানি-খুনাখুনি। এসব প্রেক্ষাপটে বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে সহমতের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের দাপটে বিরোধীরা ক্যাম্পাস ছাড়া হয়।
শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ছাত্রসংসদ। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট বিষয় নয়, দেশের নানা ক্রান্তিকালেও নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্রনেতারা। ছাত্র নেতৃত্বের হাত ধরেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। সামাজিক ও মানবিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ছাত্রসংসদ অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু সেই ছাত্রসংসদ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কাজেই এ পরিস্থিতিতে আমাদের প্রত্যাশা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ নেতৃত্ব বিকাশে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে রাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করবেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ