ডেঙ্গু আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারপাশে মশার আঁতুড়ঘর

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

কুরবানির ঈদ ও গ্রীষ্মের ছুটি শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক-কর্তৃপক্ষের ভাবনার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। এতে আক্রান্ত কয়েক শিক্ষার্থীর অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর পর, তাদের মধ্যে এ আতঙ্ক ভর করেছে। ভয়ে এখন অনেকে স্কুল-কলেজে যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। তাই কমছে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি। তবে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিচ্ছে। একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ায় তারা শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার কমার আশঙ্কা করছেন।

তারা বলছেন, মশক নিধনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সবখানেই সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমেনা খাতুন রিতুর দুই ছেলে আইডিয়ালে পড়ে। বড় ছেলেকে স্কুলে পাঠালেও ছোট ছেলেকে তিনি স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। কারণ, ডেঙ্গু আতঙ্ক। বাসায় যাতে মশা না কামড়ায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। স্কুলের ব্যবস্থা তার অজানা। তিনি বলেন, রাজধানীর স্কুলগুলোতে মশা মারার উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকা দরকার। না হলে কোন ভরসায় সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন।

রিতু বলেন, ছেলেকে স্কুল ড্রেস না পড়িয়ে ফুল হাতা শার্ট-প্যান্ট পরিয়ে স্কুলে দিচ্ছি। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রভাতী শাখায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে তিন্নী রহমান। তার মা আয়েশা অন্নী জানান, ১০ জুলাই থেকেই তিনি মেয়েকে স্কুলে দিচ্ছেন না। যে হারে ডেঙ্গু বাড়ছে, তাতে তিনি কোনো রকম ঝুঁকি নিচ্ছেন না। 

রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান ঘিরেই রয়েছে ডেঙ্গুর আঁতুড়ঘর। মশক নিধনে আবার কিছু প্রতিষ্ঠান কিনেছে মশা মারার অ্যারোসল, কয়েল, ব্যাট। কিছু স্কুল বিকাল থেকে পরদিন স্কুল খোলার আগ পর্যন্ত ক্লাসরুমের সব জানালা বন্ধ রাখছে। স্কুল শুরুর আগে মশক নিধন উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। 

মাউশির পাঁচ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নেও তৎপর দেখা গেছে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের। তবে তারা অভিযোগ করছেন, স্কুল ঘিরে চারপাশের ড্রেন, সড়কের আনাচে-কানাচে জমে থাকা পানি এডিস মশার বংশবিস্তারের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। 

রাজধানীর কাকরাইলের উইলস্ লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তায় ড্রেনের জমা পানিতে মশা খেলা করছে। ময়লা আবর্জনার স্তূপ হয়ে আছে। চারপাশে আবাসিক-অনাবাসিক ভবন ঘিরে মশার অবস্থান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, পুরো মাঠ ঢালাই করা। ক্লাস রুম, বারান্দা সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। 

ভবনের বিভিন্ন তলায় ফুল গাছ লাগানো। তবে, টবে পানি জমা নেই। মূল ভবনের নিচের বাগানও বেশ পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং পরিচ্ছন্নতকর্মী জানালেন, এ প্রতিষ্ঠানঘেঁষা পূর্ব পাশে বিশাল বড় ডোবা রয়েছে। 

একটি নির্মাণাধীন উন্মুক্ত ভবনের নিচে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট পানি জমে আছে। ডোবার পানি মলমূত্রে ভরা। সামনে টিনের বেড়া দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। ভেতরে বছরের পর বছর ধরে নোংরা পানি জমে চরম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুপাশে দুর্গন্ধ ভরা এ ডোবা শিক্ষার্থীসহ সবাইকে অতিষ্ঠ করে তোলে। 

দুর্গন্ধের সঙ্গে মশা বংশবিস্তারের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে এ ডোবা। শিক্ষকবৃন্দ জানান, ডোবার দুর্গন্ধ এবং মশার কামড় থেকে বাঁচতে প্রতিষ্ঠানের শত শত জানালা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উন্মুক্ত বারান্দায় যেতে সাহস পান না শিক্ষার্থীরা। 

দুর্গন্ধের সঙ্গে পুরো এলাকায় মশা ভনভন করে। এ অবস্থার প্রতিকার চেয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে বহুবার বলা হলেও, কোন অদৃশ্য কারণে ডোবা ভরাট বা পানি শুকানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. নাসির উদ্দিন (চলতি দায়িত্ব) বলেন, এখানে ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। ডেঙ্গু সবাইকে উদ্বেগে ফেলছে। আমরা নিচ তলায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের উপর তলায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। প্রতিদিন মশা নিধক স্প্রে করা হচ্ছে। ডোবা ভরাট বা পানি শুকালে শঙ্কা কমে আসত। জানালা খোলা যেত। 

দীর্ঘদিন ধরেই দখলে রয়েছে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ সামনের সড়ক ফুটপাত। কিছু স্থানের ড্রেনে মলমূত্রও চোখে পড়েছে। স্কুল ঘেঁষা কলোনির বিভিন্ন স্থানে পানি জমে রয়েছে। মূল গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সবুজ মাঠ চোখে পড়ে। গাছের নিচে স্যাঁতসেঁতে থাকলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃষ্টির পানিতে এমন দেখায়। রোদে শুকিয়ে যায়। 

সবুজ মাঠে মশার উপদ্রব স্পষ্ট দেখা গেছে। এ প্রতিষ্ঠানের তিন পাশেই আবাসিক এলাকা। এর দেওয়াল ঘেঁষা খালি স্থানে ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। চোখে পড়েছে অব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রীও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয় চলে এসেছে। সচেতন হচ্ছে। অনেকেই শরীরে ক্রিম লাগিয়ে স্কুলে আসছে। 

প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বলেন, নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা পর্যাপ্ত অ্যারোসল, কয়েল, ব্যাট মজুত করেছি। স্কুল শুরুর আগে-পরে এসব ব্যবহার করা হচ্ছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবনের সঙ্গে আমাদের জীবন সম্পৃক্ত। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ভেতরের পরিবেশ ঠিক রাখতে। শিক্ষার্থীরা যেন নির্ভয়ে ক্লাস করতে পারে। উপস্থিতির হার যেন না কমে। বাহিরের পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ। 

কারণ বাইরে থেকে মশা খুব সহজেই ভেতরে আসতে পারে। এ জন্য সবাইকে সচেত হতে হবে। সিটি করপোরেশনের তরফেও মশা মারার তেল ও ব্লিচিং যথাযথ ছিটানো জরুরি। এ প্রতিষ্ঠানটি ছাড়াও রাজধানীতে তাদের আরও দুটি শাখায়ও একই নিয়মে মশক নিধন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

রাজধানীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারটি শাখা রয়েছে। প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রভাতী শাখা প্রধান সৈয়দা তানজীনা ইমাম জানালেন, স্কুলে জাতীয় সংগীত ও ক্লাস শুরুর আগে ডেঙ্গু নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, অভিভাবকবৃন্দকেও ডেঙ্গু তাড়া করছে। শুধু স্কুল পরিস্কার রাখলেই হবে না, যে সড়ক ধরে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাতায়াত করে, তাদের বাসাবাড়িও এডিস মশামুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। 

একই সঙ্গে খোদ শিক্ষার্থীরা ডেঙ্গু সচেতনতার বার্তা বহনের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তানজীনা ইমাম বলেন, সড়কের পাশের ড্রেন উন্মুক্ত থাকে, সেই স্থানগুলো মশার আঁতুড়ঘর। ডেঙ্গুতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। আমরা সচেতন, অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। 

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রাথমিক শিক্ষক জানান, রাজধানীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৩২৪টি। সব কয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মশক নিধনে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষক-কর্মচারী উদাসীন হলেই কোমলমতি শিশুদের বিপদ হতে পারে। 

এদিকে অভিভাবক ও শিক্ষকবৃন্দ বলছেন, ডেঙ্গুর বংশবিস্তার রোধে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের যদি আগামী কয়েক মাস লাগাতার প্রচারের আওতায় রাখা যায়, তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বেই। কারণ বড়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যদি সচেতন হয়-ঘর বাইরে থাকা সাধারণ মানুষও সচেতন হবে। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মাদরাসা শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha মাদরাসা শিক্ষকদের আগস্ট মাসের এমপিওর চেক ছাড় মাই*রা শ্যাষ কইরা দেন, শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন দুই ভিসি - dainik shiksha মাই*রা শ্যাষ কইরা দেন, শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন দুই ভিসি আমি আশ্বাস দিচ্ছি, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha আমি আশ্বাস দিচ্ছি, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপদেষ্টা গুচ্ছের ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ ধাপের ভর্তি ৩ সেপ্টেম্বরের পর - dainik shiksha গুচ্ছের ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ ধাপের ভর্তি ৩ সেপ্টেম্বরের পর অষ্টম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন শুরু ১০ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন শুরু ১০ সেপ্টেম্বর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান রকিব উল্লাহ - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান রকিব উল্লাহ শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি পাঠ্যবই থেকে বাদ দিয়েছিলেন কামাল চৌধুরী - dainik shiksha শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি পাঠ্যবই থেকে বাদ দিয়েছিলেন কামাল চৌধুরী প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ - dainik shiksha প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসকদের শাটডাউন স্থগিত - dainik shiksha সোমবার রাত ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসকদের শাটডাউন স্থগিত শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন : এহছানুল হক মিলন - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন : এহছানুল হক মিলন পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ৪৯ হিন্দু শিক্ষক - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন ৪৯ হিন্দু শিক্ষক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028321743011475