ড. ইউনূসের ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’

সাধন সরকার, দৈনিক শিক্ষাডটকম |
বর্তমান পৃথিবীর আলোচিত তিনটি সমস্যা হলো দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ। সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার বিপরীতে কাজ করে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। আর মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ সভ্যতাকে তিলে তিলে ধ্বংসের দ্বারে ধাবিত করে। বর্তমানে তিনটি সমস্যাই আধুনিক, টেকসই ও বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষুদ্রঋণের ধারণা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে তার সাড়াজাগানো বই ‘এ ওয়ার্ল্ড অব থ্রি জিরোস’ পৃথিবীতে তিনটি প্রধান সমস্যার নতুন ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। 

থ্রি জিরো বা তিন শূন্যের পৃথিবী পুরো পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ ছাড়া এ পৃথিবীর মুক্তি নেই। মূলত এটি একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। উল্লিখিত তিনটি সমস্যা দূর করতে সবার আগে ড. ইউনূস কিছু বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, তরুণরা এই পৃথিবীর বড় সম্পদ ও পরিবর্তনের দূত। পরিবর্তন আনতে হলে তরুণদের সম্পৃক্ততা ছাড়া সম্ভব নয়। যুগে যুগে তরুণরা পৃথিবী পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। তারুণ্যের নবজোয়ারের কাছে অন্য কিছু তুচ্ছ। তরুণরা যত বেশি অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবে পৃথিবীর বদল ঘটানো তত সহজ হবে। তিনি প্রযুক্তিগত দক্ষতার কথা বলেছেন। পৃথিবীতে যে জিনিসটির বদল সবচেয়ে বেশি দ্রুত হচ্ছে সেটি হচ্ছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এটি দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে তিনি প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। তিন শূন্যের পৃথিবী গড়তে হলে অন্য আরেকটি বিষয়ের ওপর তিনি নজর দিয়েছেন। সেটি হলো সুশাসন। সুশাসন আনয়ন না হলে কোনো লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব হবে না। শুধু আইন থাকলে হবে না। আইনের যথাযথ ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ থাকতে হবে। সুশাসনের অভাবে অনেক ভালো অর্জনও বিসর্জন হয়ে যেতে পারে। এছাড়া তিনি সামাজিক ব্যবসার ওপর দৃষ্টি দিয়েছেন। তার মতে, ব্যবসা শুধু লাভের জন্য করলে হবে না। ব্যবসা হবে মানুষের কল্যাণ ও সমস্যা সমাধানের জন্য।

 
দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণের মতো সমস্যা মানুষের দ্বারা সৃষ্ট। বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই দারিদ্র্য ও বেকারত্ব তৈরি হয়েছে। ড. ইউনূসের মতে, তরুণদের অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, নিজের অর্জিত শিক্ষা ও দক্ষতা দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষিত তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। চাকরি করে কেউ কখনো পৃথিবীর বদল ঘটাতে পারেনি। কিন্তু নিজের চিন্তা ও চেতনার পরিবর্তন ঘটিয়ে উদ্যোক্তা ও নিজের আইডিয়া বাস্তবে রূপ দেয়ার মাধ্যমে অনেকে পৃথিবীতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বদল ঘটাতে সক্ষম হচ্ছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নিজস্ব ক্ষমতা ও উদ্ভাবনী শক্তি রয়েছে। 
 
অনুকূল পরিবেশে সেটির যথাযথ রূপ দিতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমে নিজে যেমন আলোকিত হওয়া সম্ভব, তেমনি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়। চাকরি নয়, একজন উদ্যোক্তাই পারে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজে সাবলম্বী হতে এবং অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে চারপাশ আলোকিত করতে। তার মতে, দারিদ্র্য প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি হয়নি, এটি মনুষ্যসৃষ্ট । অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দারিদ্র্য নামক অভিশাপ দূর করা অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। দারিদ্র্য দূর করতে ক্ষদ্রঋণ গ্রহণ ভালো ব্যবস্থা হতে পারে। ক্ষুদ্রঋণের অর্থের সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবহার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তন পুরো পৃথিবীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শত্রু মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। শিল্পযুগের পর থেকে একটু একটু করে কার্বন নিঃসরণ করতে করতে আর পুঁজিবাদের ভারসাম্যহীন প্রসারে আজকের পৃথিবী নামক ছোট্ট গ্রহটির অবস্থা নাজুক। অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। সবুজ অর্থনীতি ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে বদল ঘটানো সম্ভব। দূষণ ঘটিয়ে এবং পরিবেশের ক্ষতি করে বাসযোগ্য পৃথিবী গড়া সম্ভব নয়। কার্বন নিঃসরণ কমাতে না পারলে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ থমকে যাবে। তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করেই ব্যবসা করার কথা বলেছেন।

ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য ড. ইউনূসের তিন শূন্যের পৃথিবী বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। তার মতে, শিক্ষিত তরুণ দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কাছে পরাজিত হতে পারে না। তারুণ্যের শক্তির কাছে সব সমস্যা সমাধানে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। তবে সবার আগে সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসার পথ সুগম করতে হবে। উন্নত, টেকসই, ন্যায়সঙ্গত সমাজ গঠনে ড. ইউনূসের তিন শূন্যের পৃথিবী বা থ্রি জিরোস মডেল নতুন পৃথিবী গড়ার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
 
লেখক: শিক্ষক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031869411468506