ঢাকায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকার ১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা মিলেছে।
কোনো এলাকার ৫ শতাংশ বাড়িতে এই লার্ভা পাওয়া গেলে সেই পরিস্থিতিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গত ১৮ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত এক জরিপের চালানো হয়। জরিপে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, হাসপাতালের বিছানা বাড়িয়ে লাভ হবে না, প্রয়োজন ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা। সেজন্য ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা আর উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত রোগ। এডিস মশার লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা জন্মায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি লার্ভা পাওয়ার অর্থ ঢাকায় এবার এডিস মশাও বেশি পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছর ২৭ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৭৫৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৪৭ জনের। বাংলাদেশে এর আগে জুন মাস পর্যন্ত কখনো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত পরিমাণ রোগী হাসপাতালে ভর্তি ও মারা যায়নি।
জরিপে যা জানা গেছে
জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ১৮ থেকে ২৭ জুন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮ ওয়ার্ডে জরিপ চালিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক মশার প্রজননস্থল শনাক্ত, পূর্ণাঙ্গ মশা ও লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ ও ম্যাপিং করা হয়েছে।
জরিপের প্রথম আট দিনের তথ্যে দেখা গেছে, ২৫ জুন পর্যন্ত ঢাকার ২ হাজার ৫১১ বাড়ির মধ্যে ৪৫৩ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। আর ২ হাজার ৭৩৮টি পাত্রের মধ্যে ৬২৫টিতে পাওয়া গেছে এই লার্ভা।
ঢাকার ১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা
ডিএনসিসির ৯৬২ বাড়ির মধ্যে ২১০টি বাড়ি এবং ৯৯৪টি পাত্রের মধ্যে ২৭৭টি পাত্র এবং ডিএসসিসি এলাকার ১ হাজার ৫৪৯টি বাড়ির মধ্যে ২৪৩টি বাড়ি এবং ১ হাজার ৭৪৪টি পাত্রের মধ্যে ৩৪৮টি পাত্রে মিলেছে এডিস মশার লার্ভা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি এলাকার হাউস ইনডেক্স ২১ দশমিক ৮, ব্রুটো ইনডেক্স ২৮ দশমিক ৭৯। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় হাউস ইনডেক্স ১৫ দশমিক ৭, ব্রুটো ইনডেক্স ২২ দশমিক ৪৭।
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বলা যায়। আর হাউস ইনডেক্স পাঁচের বেশি হলে তাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
জরিপে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবিরুল বাশার বলেন, হাউস ইনডেক্স পাঁচের উপরে গেলেই বিপজ্জনক বলা হয়। সেখানে ঢাকায় ১৮ এর বেশি!
ডেঙ্গু ছড়ানোর ঝুঁকি অন্য সময়ের চেয়ে বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাচ্ছি। ডেঙ্গু রোগীও মওসুম শুরুর আগে থেকেই বাড়ছে। আমার কাছে মনে হয়, আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসে বড় একটা একটা আঘাত আসবে।’
গত ১৮ জুন থেকে জরিপ শুরু হওয়ার প্রতিদিন ২১টি দল বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে যান। তিনজনের একেকটি দল নির্দিষ্ট এলাকার ১৫টি বাড়ি জরিপ করেন। এভাবে প্রতিদিন ৩১৫টি বাড়ি পরিদর্শন করেন তারা। আবাসিক, নির্মাণাধীন, বহুতল ভবন, একতলা ভবন, খোলা জায়গা এবং বস্তিও রয়েছে জরিপে আওতায়।
জরিপকারীদের সঙ্গে ঘুরে অনেক বাড়িতেই এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি দেখা গেছে। গত ১৯ জুন ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের মগবাজার, দিলু রোড এবং ইস্কাটন এলাকার ১৫ বাড়ি জরিপ করে নয়টিতেই লার্ভার উপস্থিতি মেলে। সেদিন ৩১৫টি বাড়ি জরিপ করে ৭৪টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
মঙ্গলবার গুলশানের ১৫ বাড়ির চারটিতেই এডিস মশার লার্ভা খুঁজে পান জরিপকারীরা। ওই এলাকার ১৩৬ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর হোল্ডিংয়ের বহুতল আবাসিক ভবনের নিচতলায় গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার অংশ সাজানো গোছানো, পরিপাটি। জরিপকারীররা নিচতলায় রাখা ফুলের টবসহ বিভিন্ন পাত্র পরীক্ষা করেন। সেসব জায়গায় লার্ভা পাওয়া যায়নি। কিন্তু ওই বাড়ির সীমানা দেয়াল এবং ভবনের মাঝখানে রাখা প্লাস্টিকের ড্রামের ঢাকনার ওপর সামান্য একটু পানিতেই লার্ভা দেখতে পান জরিপকারীরা। লার্ভাসহ ওই পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য নিয়ে আসেন তারা। এ ছাড়া ওই সড়কের ১৩ নম্বর বাড়ির এক কোণে উল্টো করে রাখা ফুলের টবের খাঁজে জমা পানিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
বাড়ির মালিক নুরুন্নাহার রহমান জানান, বাগানের কোথাও যেন পানি না জমে সে নির্দেশনা তিনি মালিকে দিয়েছেন। তবে দুদিন আগে সে ঈদের ছুটিতে গেছে। এ কারণে পানি জমে থাকতে পারে।
জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ‘এবার এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ১৫টি বাড়ি জরিপ করে নয়টি বাড়িতে লার্ভা পাওয়ার ঘটনা গুলশানেও আছে। আর আমরা প্রথম দিন ৩১৫ বাড়ির মধ্যে ৬০টি বাড়িতে লার্ভা পেয়েছিলাম। গুলশান-বনানীর অবস্থাও এবার ভালো না। এবার ব্রুটো ইনডেক্স ভালো না, যথেষ্ট খারাপ।’