ঢাকা নিম্নমানের শহরই রয়ে গেলো!

সাধন সরকার |

ঢাকা শহর ঘিরে পরিকল্পনা কম হয়নি। ঢাকাকে ঘিরে শুধু পরিকল্পনা আর কর্মশালা করা হয়, কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয় না। বাসযোগ্যতা বিবেচনায় ঢাকা নিম্নমানের শহরই রয়ে গেলো। প্রতিবছর জলাবদ্ধতা নিরসনে, যানজট মোকাবিলায়, ডেঙ্গু সমস্যা মোকাবিলায়, পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণ, বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ প্রতিরোধে শত শত সেমিনার, কর্মমালা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও সমস্যা যে তিমিরেই ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ঢাকার বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ঢাকাকে বাসযোগ্য, সচল, সুন্দর, আধুনিক ও উন্নত ঢাকা বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আসলে কী ঢাকাবাসীর সমস্যা দিন দিন কমছে? শুধু বর্ষা মৌসুমের আগে-পরের সময়ে ডেঙ্গু ত্রাস সৃষ্টি করলেও এখন পুরো বছর নগরে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। বায়ু আর শব্দদূষণের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর একটি। চিরচেনা যানজট ভোগান্তির কারণ হিসেবেই রয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা যেনো অনিবার্য পরিণতি। নতুন করে পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণ নগরবাসীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমস্যা কমছে নাকি আরো ঘনীভূত হচ্ছে নগরবাসী ভালো বলতে পারবেন।

ঢাকা এক আজব শহর! এ শহরে টাকা ওড়ে, স্বপ্ন ওড়ে। এ শহর কাউকে নিঃস্ব করে, কাউকে আবার করে কোটিপতি। তবুও সবার আকষর্ণের নাম ঢাকা। ঢাকার মতো এমন জল-সবুজে শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। ভেতরে খাল আর চারপাশে নদী। ঢাকার খালগুলো যদি দখলমুক্ত করে নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত করে স্বল্প পরিসরে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতো তাহলে মশার বিস্তারও রোধ করা যেতো। ঢাকার মতো অনেক পুরনো শহর পৃথিবীতে আছে কিন্তু সেসব শহর এতো অপরিচ্ছন্ন নয়। তিলোত্তমা ঢাকা একটু একটু করে প্রসারিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। সুউচ্চ ভবনগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে। বড় বড় শপিং মল হচ্ছে। পুরান ঢাকা বদলে যাচ্ছে। আধুনিক ও উন্নত ঢাকার প্রতিশ্রুতি ভেসে বেড়াচ্ছে নগর জুড়ে। ঠিক একই সঙ্গে ভূমিকম্পের ভয়, অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ শহরের দিকে দিকে বৈষম্য। এ শহরে কোনো শিক্ষার্থী বিনা ফিতে যেমন লেখাপড়া করছে, আবার বছরে ত্রিশ লাখ টাকার ফিতেও লেখাপড়া করছে অনেকের সন্তান।

স্বপ্নের রাজধানী ঢাকা বেশ বহু বছর ধরে নানাবিধ সমস্যা-সংকটে জড়িত। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোনমিষ্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’ প্রতিবছরের ন্যায় চলতি বছরও ‘বৈশ্বিক বসবাসযোগ্যতা শীর্ষক জরিপ-২০২৪’ প্রকাশ করেছে। যথারীতি এ তালিকায় বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান ১৭৩টি শহরের মধ্যে ১৬৮তম। জরিপে বসবাসযোগ্যতা নির্ধারণে সুপরিসর আঙ্গিকে বেশ কয়েকটি মানদণ্ড বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো ইত্যাদি। গত প্রায় কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন জরিপে বসবাসঅযোগ্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম সারির দিকে! ঢাকা শহরের মানুষকে প্রতিদিন নানা সমস্যার মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বাতাসে সীসা, খাদ্যে ভেজাল, গ্যাস-পানির সমস্যা বহুদিন ধরে চলে আসছে। উচ্চ খরচে চিকিৎসা সেবা পাওয়া গেলেও তার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে। ফুটপাত চলে গেছে দখলকারীদের কব্জায়। সড়কে, অলিতে-গলিতে তারের জঞ্জাল এ শহরে অন্যতম এক সমস্যা। 

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দিনে দিনে ঢাকার আকার বাড়ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের যানজটে পড়ে নাকাল হতে হচ্ছে। মূলত সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় ঢাকার জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু-এ চারটি নদীই আজ দুর্বিষহ দূষণের শিকার।

খালগুলো তো বহু আগেই দখল হয়ে আছে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্যই এই শহর নরক যন্ত্রণার সমান। এ নগরীতে পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের ফলে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। অতি মাত্রায় শব্দদূষণ নগরবাসীকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। প্লাস্টিক আর পলিথিন দূষণের বিস্তার তো আছেই। বিল্ডিং কোড না মেনে ও অপরিকল্পিতভাবে ভবন গড়ে তোলার ফলে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে সমন্বয়ের অভাবের দরুন মাঝেমাঝেই নগরবাসীর বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তথা দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব বলে মনে করি। আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের বাসযোগ্য রাজধানী ও টেকসই আধুনিক শহর ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। পৃথিবীর অনেক দেশে দুটি রাজধানী আছে। আবার অনেক দেশে রাজধানী সরিয়ে অন্যত্র স্থাপনেরও নজির আছে। ঢাকা শহরের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজধানী স্থানান্তর কিংবা অন্য কোনো স্থানে প্রশাসনিক রাজধানীর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এতে করে ঢাকার ওপর চাপ অনেকটাই কমে যাবে। 

লেখক: শিক্ষক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047118663787842