সবাই তো সুখী হতে চায়, তবে কেউ সুখী হয় কেউ হয় না। শুনেছি সবার কপালে নাকি সুখ সয় না। মান্না দের কণ্ঠে এই অমর গানটি কতবার যে শুনেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে এই গানটির তৃতীয় লাইনটির মর্মার্থ কত গভীর ও বেদনাদায়ক তা আগে কখনো এভাবে উপলব্ধি হয়নি, যা আজ হচ্ছে। কারণটি আশা করি নিচের বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট হবে।
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের যাত্রা সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু হলেও এটা রেশনাল আকৃতি ও আনুষ্ঠানিক রূপ পায় বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে অর্থাৎ ১৯০০ সালে, তাত্ত্বিকভাবে ম্যাক্স প্লাংকের কালোকায় বস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে। তারপর প্রথিতযশা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, শ্রোয়েডিনগার, হাইসেনবার্গ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পল ডিরাক, ফাইনম্যান, এনরিকো ফার্মি, ওয়ালটার কোন, আবদুস সালাম, মারি গেইলম্যান, লানডাউসহ আরো অনেকের হাতের ছোঁয়ায় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। ফলে এটা আজ পদার্থবিজ্ঞানের একটি পৃথক শাখা হিসেবে উন্নত বিশ্বে সমাদৃত ও প্রতিষ্ঠিত। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া বস্তু জগতের কোনো সূক্ষ্ম ভৌত ধর্ম পরিষ্কারভাবে বোঝা অসম্ভব। এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে উন্নত দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রগ্রামে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ চালু রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ও প্রিন্সটনের মতো বিশ্বসেরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্তরেও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। বলাবাহুল্য যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতি না হলে গোটা সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকত শতাব্দী পেছনে।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একই উদ্দেশ্যে ১৯৭৫ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। সগৌরবে তিন বছর চলার পর বিভাগটির কার্যক্রম অজানা কারণে বন্ধ থাকে। যুগের ও সময়ের তাগিদে ২০০৭ সালে বিভাগটি পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং বিভাগটির অবকাঠামো গঠন ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর নিমিত্তে আমাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের উন্নয়নে মনোনিবেশ করি। ২০০৮ সালে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএস (Master of Science) প্রগ্রাম চালু করি এবং তিল তিল করে শূন্য থেকে বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থায় উন্নয়ন করি। একই সঙ্গে আটজন শিক্ষকের ও চারজন কর্মচারীর পদ সৃষ্টি করে পুরোদমে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম (এমএস, এমফিল ও পিএইচডি) পরিচালিত করতে থাকি। প্রতিবছর বিভিন্ন বিভাগ যেমন—পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, ঊঊঊ, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা এসে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এঁদের মধ্যে বুয়েটের স্নাতক ডিগ্রিধারী ও মেধাবী শিক্ষার্থীও রয়েছেন। সুদীর্ঘ ৯ বছর এঁদের পড়িয়ে বুঝতে পারলাম যে মাস্টার্সের অনেক শিক্ষার্থী একাডেমিক্যালি অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ম্যাথমেটিকসে শক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড ও মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানে পরিষ্কার ভৌত ধারণা না থাকায় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয় ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পারছেন না; আর সে রকমভাবে তৈরি হতে না পারলে গবেষণার দিগন্তরেখা স্পর্শ করা অসম্ভব।
এই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের সর্বাগ্র স্তরে গবেষণা করার মতো শিক্ষার্থী তৈরি করতে হলে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় গাণিতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও মৌলিক ভৌত ধারণা শিখিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে আন্ডারগ্রেড প্রগ্রাম চালু করার এটাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। এর সঙ্গে একটি সংলাপ আন্ডারগ্রেড খোলার ব্যাপারে আরো বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। ড. অর্গ তরফদার, ভারতের খড়গপুর আইআইটিএর স্বনামধন্য অধ্যাপক। তাঁর একজন এমএস ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড ও প্রিন্সটন এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রগ্রামে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। তিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার আসে। ছাত্রটি তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার গ্রহণ করবেন। এরই মধ্যে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ড. অর্গ তরফদারকে ফোন করে অনুরোধ করেন ছাত্রটিকে স্ট্যানফোর্ডে পাঠাতে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কী রকম কোয়ালিটির ছাত্র ভারত তৈরি করছে যাঁদের নিয়ে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কাড়াকাড়ি লেগে যায়। ব্যাপারটি শুনে আমার খুবই ঈর্ষা হলো এই ভেবে যে যদি আমরা এ রকম মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী তৈরি করতে পারতাম! নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করলাম, বাংলাদেশের সীমানার ৩০০ কিলোমিটার বাইরে পারলে ৩০০ কিলোমিটার ভেতরে আমরা পারব না কেন?
এই সংকল্প নিয়ে অবশেষে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক প্রগ্রাম চালু হলো। ২৫টি সিটের বিপরীতে ২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হলেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও সেখানে ভর্তি না হয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটা কত না আনন্দের বিষয়। আমার অনেক সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব আছেন, যাঁদের সন্তানরা বুয়েটে পড়েন। এঁদের যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন ‘আপনার ছেলে বা মেয়ে কোথায় ভর্তি হয়েছে’? ওনারা গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে ঠোঁটে তৃপ্তির হাসিরেখা টেনে উত্তর দেন, বুয়েটে। আজ সেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা বুয়েট ছেড়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। গতানুগতিক স্রোতের উল্টো প্রবাহ আমাদের জন্য কি কম সুখের ছিল? এখানে এ কথাটি বলা আবশ্যক যে আমার এক সহকর্মী, তিনি বর্তমানে একটি বিভাগের চেয়ারম্যান, আমাকে জানান যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ বন্ধ না হলে তাঁর ছেলে বুয়েটে না পড়ে এখানে ভর্তি হতো। আমার আরো কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের কাছে একই রকম কথা শুনেছি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে অধিক হারে শিক্ষার্থী বুয়েট ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতেন। গর্বের সঙ্গে বলার সুযোগ হয়েছিল যে দেশের সেরা শিক্ষার্থীরা, স্বর্ণযুগের মতো (১৯৫৫-১৯৭৫) আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। আক্ষেপ, হতভাগা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কপালে এই সুখটুকু আর সইল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন প্রগ্রামটি অযাচিতভাবে বন্ধ করে দিল।
মান্না দের গানের লাইনটির মর্মার্থ হৃদয়ের গভীর তলদেশ থেকে চরমভাবে অনুভব করলাম। এখানে একটি কথা না বললেই নয়। অনেকে হয়তো ভাবেন যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের মতোই একটি বিভাগ। শিক্ষার্থীরা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এখানে ভর্তি হবেন, চার বছর অধ্যয়ন করে স্নাতক ও পঞ্চম বর্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করবেন এবং পরে এই সার্টিফিকেট দেখিয়ে সরকারি, বেসরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবেন। কিন্তু যে বিষয়ে অধ্যয়ন করলেন সে বিষয়টি নিয়ে নিজের ক্যারিয়ার বিল্ড করবেন এটা মোটেও উদ্দেশ্য নয়। এদিক থেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের লক্ষ্য সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক প্রগ্রামের মূল লক্ষ্য হলো, যেসব শিক্ষার্থী এই বিভাগে ভর্তি হবেন তাঁরা বিষয়টিকে নিজের ক্যারিয়ার বিল্ডিংয়ে গ্রহণ করবেন। পরে ভৌতবিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় অনন্য অবদান রেখে নিজের ক্যারিয়ারের উন্নয়ন ঘটাবেন। অর্থাৎ নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির মাধ্যমে আপন দেশ ও বিশ্ব উন্নয়নে নিজের অংশীদারি বাড়াবেন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবেন। যাহোক, আশা করি শিগগিরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বোধোদয় হবে, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের উপযোগিতা উপলব্ধি করবে এবং স্নাতক প্রগ্রামে শিক্ষার্থী ভর্তি আবার শুরু করবে। সেই সুখটুকু ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক : অধ্যাপক, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ