ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদ নির্বাচনের জন্য আহূত সাম্প্রতিক সিনেট অধিবেশন এবং তা থেকে জন্ম নেওয়া নানা ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে অথবা ইন্টারনেট গণমাধ্যমে যদি আমরা কিছু লিখি, তাহলে আমাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চিঠি আসতে পারে। তাতে লেখা থাকতে পারে, আমাদের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে, অথবা আমাদের বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি কমিটি গঠন করা হয়েছে অথবা যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মিশেল ফুকোর বরাতে বলা যায়, এখন চলছে শাসন ও শাস্তির কাল। ভয়ার্ত-সতর্ক চোখমুখ আশপাশে খুব সুলভ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আজকাল প্রায় সব ব্যাপারেই চুপচাপ থাকেন। কারণ, সেই শাসন ও শক্তির কলাকৌশল ও তার প্রয়োগ আমাদের প্রতিবাদের স্বাভাবিক প্রবণতাকে ভেঙেচুরে দিয়েছে। কিন্তু ঘটনা এত দূর গড়িয়েছে যে স্রোতের অনুকূলে চলা সবচেয়ে সাদাসিধে মানুষটিরও চুপ করে থাকার জো নেই। কারণ, গত কয়েক দিনে যা ঘটেছে, তার কুশীলব যাঁরাই হন, লজ্জার কাদা সবার গায়েই লেগেছে। তাই আমাদের লিখতেই হচ্ছে। দেশবাসীকে আমাদের জানানোর দায় আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষকই এসব অপছন্দ করেন। সবার বিবেক ও জাগ্রত চেতনা লুপ্ত হয়নি।

গত ২৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল। তাঁদের দাবি ছিল, শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া সিনেট অধিবেশন হতে পারে না। তাই আগে ডাকসু নির্বাচন দিতে হবে, তারপর শিক্ষার্থী-প্রতিনিধিসহ সিনেট অধিবেশন ডাকতে হবে। কয়েক দশক হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নেই, ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের বক্তব্য প্রদান বা অংশগ্রহণের সুযোগও নেই। সেই হিসেবে এটি একটি ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবি। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এসে মাননীয় আচার্যও ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটেই শিক্ষার্থীরা, যাঁদের সিংহভাগ ছিলেন বাম সংগঠনের সদস্য, প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে হাজির হন সিনেট ভবন প্রাঙ্গণে। কিন্তু তাঁরা সিনেট ভবন প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলেন প্রধান ফটক বন্ধ এবং ফটকের ওপারে অপেক্ষা করছেন কয়েকজন শিক্ষক।

শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ছিল মানববন্ধনের। ফটক বন্ধ দেখে তাঁরা ফটক ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলেন। ডাকসু নির্বাচনের দাবি গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি, মূল সিনেট ভবনের বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত ফটকটি বন্ধ রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। কিন্তু এরপরই ঘটে সেই মর্মন্তুদ ঘটনা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি। শিক্ষার্থীদের বাধা দিতে এগিয়ে আসেন শিক্ষকেরা। ভিডিও ও স্থিরচিত্রে দেখা যায়, শিক্ষকেরাই আগ্রাসী, শিক্ষার্থীরা সেখানে আক্রান্ত। শিক্ষকদের আগ্রাসনের শিকার হন ছাত্রীরাও। ছবিতে শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে শিক্ষকদের আক্রমণের শিকার নারী শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে আনার প্রচেষ্টা করতে দেখা গেছে।

এর আগেও ২০০২ সালে শামসুন নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর হামলা হয়। কিন্তু সেখানে আক্রমণে ছিল পুলিশ। আর এবার স্বয়ং শিক্ষকেরা, যা প্রমাণ করে, শিক্ষকদের যে নৈতিক অবস্থানে থাকার কথা, সেখান থেকে অধঃপতন ঘটেছে। আক্রমণকারী শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন একজন সহকারী প্রক্টর, ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার দায়ে একজন অভিযুক্ত শিক্ষক, ন্যূনতম যোগ্যতা ছাড়া নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক এবং একজন বহিরাগত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আদর্শিক অবস্থান থেকে বিচ্যুতির নানাবিধ নমুনা এখানে উপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এমনকি বহিরাগত শিক্ষক সম্পর্কে এমনও বলেছেন যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে আবেদন করেছেন এবং তিনি শিক্ষক হয়েও যাবেন। প্রশ্ন হলো যিনি একবার শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন, তিনি কি শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করতে পারেন? এই সব শিক্ষকের কৃতকর্মের দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের ওপর পড়ে যে! সেই দায় স্থানান্তরের দায়িত্ব তো তাঁদের নিতে হবে। আপনি ছাত্রের চশমা ভাঙবেন, ছাত্রীর ওড়না টানবেন, তাঁদের মাটিতে ঠেলে ফেলবেন, আর তা করতে গিয়ে আপনার আঙুল ভাঙবে—আপনি সমবেদনা তো দূরের কথা, আমাদের কাছ থেকে আপনি পাচ্ছেন নিরন্তর ধিক্কার। কারণ, আপনি আপনার সত্যিকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে পুরো সমাজের কাছে আমাদের হেনস্তা করেছেন।

দিন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক কূটকৌশল ও তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিদ্যায়তনিক মান বিকিয়ে অনুগত বাহিনীর যে পেশি প্রদর্শনী আমরা দেখলাম এবং তার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে যে পর্যায়ে নামিয়ে আনা হলো, তার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এড়াতে পারেন না। উচ্চ থেকে নিচ, যাঁরাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের জন্য আমাদের দিক থেকে তীব্র নিন্দা বরাদ্দ রইল।

শোনা যাচ্ছে, এই ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আমরা আশা করছি, সেই তদন্ত কমিটি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করবে। কে আক্রমণকারী আর কে আক্রান্ত, তা যথাযথভাবে শনাক্ত হবে। আমাদের বিবেচনায় শাস্তি হওয়া উচিত সেই সব শিক্ষকের, যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছেন এবং পুরো শিক্ষক সমাজের অবয়বে কালিমালেপন করেছেন। আর তদন্ত কমিটির নাম দিয়ে শিক্ষার্থীবিরোধী সম্ভাব্য যেকোনো প্রহসনমূলক পদক্ষেপের আগাম প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম।

লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034279823303223