ঢাবি শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ ও শিক্ষকের স্মৃতিচারণ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজধানীর চানখারপুল থেকে গামছায় ঝোলানো অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে মাসুদ আল মাহাদী অপু নামে সাবেক ওই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে চকবাজার থানা পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন অপু। তার হল ছিল মাস্টার দা সূর্যসেন। পড়াশোনা শেষ করেন ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। চাকরি ছেড়ে গত দেড় বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিসিএসের। ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। 

লাশ উদ্ধারের পর মাসুদ আল মাহাদী অপুর স্মৃতিচারণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা (এমসিজে) বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক।

‘অপুকে ধারণ করার যোগ্যতা সিস্টেমের নেই’ শিরোনামে দেওয়া স্ট্যাটাসে ঢাবি অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেছেন, ‘সে পৃথিবীকে তার নিজের যোগ্য মনে করে নি। তাই সে অন্য কোথাও চলে গেল।’

অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের হুবুহু তুলে ধরা হলো :

মাসুদ আল মাহাদী (অপু) মেধাবি ছাত্র ছিল, সত্যিকারের মেধাবি। ফলাফল ভালোও করতো। তবে গতানুগতিক ভালো ফলাফল করাদের মতো সে ক্লাসে খুব নিয়মিত ছিল না। সে প্রশ্ন করতো, প্রতিবাদ করতো। ষাটের দশক কিংবা নিদেনপক্ষে আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেসব শিক্ষার্থী নিয়ে গর্ব করতো, যাদের কারণে ছাত্র আন্দোলন বিষয়টা একটা স্বর্ণালী এক রোমান্টিসিজম এখন, অপু ছিল সে ধরনের শিক্ষার্থী।

অনার্সে সে থার্ড হয়েছিল। অনার্সের রেজাল্টের পর একদিন অপুকে বললাম, মাস্টার্সের এক বছর বাড়তি একটু মনোযোগ দিলেই তুমি প্রথম হতে পারবা। সে বললো, আমি তো প্রথমই হতাম অনার্সে। হিসেব করে দেখেছি, একজন মাত্র শিক্ষক সেই প্রথম বর্ষ থেকে যে পরিমাণ কম নম্বর দিয়ে আসছেন, ওনার কোর্সে এভারেজ নম্বর পেলেই প্রথম হতাম। 

অপু আত্মহত্যা করেছে শুনছি। সিস্টেম কীভাবে প্রখর এক তরুণকে এদিকে ঠেলে দিতে পারে, তার একটিমাত্র উদাহরণ দিলাম। যেসব শিক্ষার্থী নিজে চিন্তা করতো, প্রশ্ন করতো ওই শিক্ষক সাধারণত তাদের অপছন্দ করেন, এবং বেছে বেছে ভিক্টিমাইজ করেন।  তিনি আবার সব ধরনের ভিসির প্রিয়পাত্র থাকেন, ফলে তিনি এসব করে পারও পেয়ে যান। আমি প্রসঙ্গটি একবার বিভাগে শিক্ষকদের মধ্যে তুলেছিলাম। ওই শিক্ষক বললেন, এখানে আদর্শের ভিত্তিতে কোনো কোনো স্টুডেন্টকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে! 

অবশ্য বিভাগের সেই সামর্থ্য বা ইচ্ছে কোনোটাই তেমন ছিল না, যে একজন শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীকে কিভাবে টার্গেট করে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তার তদন্ত করার বা ব্যবস্থা নেবার। আমাদের সিস্টেম অপুদের হতাশ হতে বাধ্য করে। সেই সিস্টেম, সেই শিক্ষককে আরো বেশি ক্ষমতাবান করেছে পরে। 

ওই প্রসঙ্গটা এনেছিলাম এজন্য যে, ওই সময় নতুন চেয়ার বিভাগে এসে বেশ কিছু নন-কলিজিয়েট শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশ না নিতে দেবার ব্যাপারে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন (অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক)। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিল অপু, আরশাদরা। হাওয়ায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভাসছিল যে, আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলাম (সোজা বাংলায় উস্কানি দিচ্ছিলাম)। আমি ওদের সত্যি একবার ডাকি, ডেকে বোঝানোর চেষ্টা করি, চেয়ার কিন্তু আইনানুযায়ী ঠিক আছেন। তোমরা সবটা বুঝে আন্দোলন করো। যাহোক, ওইবার সিদ্ধান্ত হয়, কঠোর সিদ্ধান্তটি, পরের সিমেস্টার থেকে কার্য়কর হবে।   

ডাকসু নির্বাচন চাই বলে যে আন্দোলন হয়েছিল, তার নেতৃত্বে অপু ছিল। আবার হলে হলে এবং ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ যে নিপীড়ন করতো তার বিরুদ্ধে যে নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের মোর্চা ছিল, তা অর্গানাইজ করতো সামান্তা আর অপুরা। অপু বামপন্থী ছিল কিন্তু তার কোনো সংগঠন সম্ভবত ছিল না। নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনই তার রাজনৈতিক চর্চার স্থান ছিল। আন্দোলন করতে গিয়ে সে নিজেও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনে অপুর নিপীড়িত হবার মুহূর্তের ছবি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে, গায়ে তার ট্রেডমার্ক কালো টিশার্ট। আমরা কয়েকজন শিক্ষক তখন নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক নামে কাজ করতাম, যা পরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামে থিতু হয়।   
 
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে, সে সাংবাদিকতা করতো, ইত্তেফাকে গেলে দুয়েকবার দেখা হয়েছে। শেষমুহূর্তে কী করতো, আমার জানা নেই, শুনছি বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সে আসলে আমার সঙ্গে কেন, সম্ভবত কোনো শিক্ষকের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতো না। যদিও আমার বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হলে, কিংবা আমি পুলিশী হামলার শিকার হলে, ক্যাম্পাসে যে প্রতিবাদ হয়েছে, তার নেতৃত্বেও সে ছিল। 

সে নিশ্চয় শিক্ষক হতে চাইতো। একাই ১০ জন শিক্ষকের কাজ করার মতো ক্ষমতা তার ছিল। কারণ সে পড়তো গভীরভাবে, শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে শেখাতে পারতো, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। কিন্তু সে বা আমি বা অনেকেই জানতো, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হবে না। এসময়ে এধরনের কাউকে বিশ্ববিদ্যালয় নেয় না। বিশ্ববিদ্যালয় চায় অনুগত গাধাদের। 

তবুও আমি চাইতাম তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকুক, তাকে কিছু পরামর্শ তো দেয়া যেত। কিন্তু খবর দিলেও সে আসতো না, ফেসবুকও ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছে বহুদিন।      

বলছিলাম সে সিস্টেমের বঞ্চনার শিকার। সাংবাদিকতার যে অবস্থা, সেখানেও নিশ্চয় সে হতাশ হয়েছে। নিরাপদ চাকরির জন্য সে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তা অপুর স্বভাববিরোধী। তার স্বভাব ধারণ করার একমাত্র জায়গা হতে পারতো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সেখানে ঢোকার সুযোগ তার নেই। 

সে পৃথিবীকে তার নিজের যোগ্য মনে করে নি। 

তাই সে অন্য কোথাও চলে গেল।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ - dainik shiksha চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করতে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার ৫ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সুখবর - dainik shiksha ৫ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস, তাপমাত্রা নিয়ে সুখবর বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে সাতক্ষীরায় শিক্ষকের মৃত্যু দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003201961517334