কখনো পাবলিক স্পিকার বা পাবলিক লিডার হতে চাননি তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত নেতা হয়ে থাকতে চেয়েছেন সব সময়। কিন্তু ছয় দফার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তার প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব তাকে জনগণের নেতা হিসেবেই চির স্মরণীয় করে রেখেছে।
আজ ২৩ জুলাই ৯৯তম জন্মদিনের আগে তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ তিনজন তার স্মৃতিচারণা করেছেন। তাদের ভাষায়, জাতীয় চার নেতার অন্যতম তাজউদ্দীন ছিলেন মেধাবী ও মানবিক মানুষ।
তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিচারণা করে ছয় দফা আন্দোলনের সময় তার সঙ্গে কারাগারে যাওয়া জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘সব সময়ই কারাগারে তিনটি কাজ করতেন তিনি। লেখাপড়া, বাগান পরিচর্যা ও বন্দিদের দুঃখ-দুর্দশা শুনতেন। তার বাগান পরিচর্যার কাজের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।’
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ছয় দফা আন্দোলনের সময় আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তখন কারাগারে ছিলেন শেখ শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কারাগারের যে সাধারণ বন্দিরা ছিল, তাদের অভিযোগগুলো তাজউদ্দীন আহমদ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং কারা কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি এগুলো জানানোর চেষ্টা করতেন সাহায্য করার জন্য। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা প্রকাশ পেত। কারাভ্যন্তরে তার সান্নিধ্যে থেকে আমি অনেক রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করেছি; বিশেষ করে তত্ত্বগত জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি, এটা আমার সৌভাগ্য।’
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ নম্বর সেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে শেখ শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি তাজউদ্দীন আহমদকে চিনি ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ওই সময় আমি দেখেছি বঙ্গবন্ধুর যেসব লেখাপড়ার কাজ ছিল, সেগুলো তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দিয়ে করাতেন এবং তাজউদ্দীন এগুলো খুব দক্ষভাবে করতেন। এরপর ১৯৬৩-৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, তখন তিনি আওয়ামী লীগের কর্মকা-গুলো পরিচালনা করতেন। যার জন্য ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন, তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে আসেন।’
তিনি বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছয় দফা আন্দোলনে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি এই আন্দোলন সংগঠনে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন এবং আওয়ামী লীগ দলের জন্য যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে কারাগার থেকে তিনি মুক্ত হন।
শেখ শহিদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্থির বুদ্ধির মানুষ। তাকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি। বঙ্গবন্ধু তাকে যে দায়িত্ব দিতেন, তা তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতেন। তিনি কখনো পাবলিক স্পিকার বা পাবলিক লিডার হতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত নেতা হয়ে থাকতে চেয়েছেন সব সময়। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু তাকে সেই মর্যাদা সব সময় দিয়েছেন।’
তার মূল্যায়নে, তাজউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল, সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। মুক্তিযুদ্ধের সব সপক্ষ শক্তিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধের সময় যাতে কোনো অনৈক্য তৈরি না হয়, তিনি সেটা সব সময় চেষ্টা করতেন।
শেখ শহিদ জানান, তাজউদ্দীনকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে খুব ধীর ও শান্তভাবে মোকাবিলা করতে দেখেছেন তিনি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তাজউদ্দীন যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা অত্যন্ত অনুকরণীয় যেকোনো রাজনীতিবিদের জন্য। ওই সময় বঙ্গবন্ধু তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই ত্যাগের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের পুরো সময় তাই নিজের পরিবারের কাছে যাননি। কলকাতাতেই তার পরিবার থাকত। কিন্তু তিনি তার পরিবার থেকে দূরে এসে মুজিবনগর সরকারের যে হেডকোয়ার্টার থিয়েটার রোডে, সেখানেই তিনি থাকতেন। সেখানে থেকেই তিনি তার সব শ্র্রম ও মেধা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা চেষ্টা করতেন বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার। এই যে ত্যাগ, নিজ পরিবার থেকে আলাদা থেকে জনগণের ভালো চিন্তা করার দৃঢ়তা, এটা তাজউদ্দীনের একটা বিশাল কৃতিত্ব বলে মনে করেন শেখ শহিদুল ইসলাম।
তাজউদ্দীন আহমদকে দেশের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের একজন দাবি করে আরেক বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিলিটারি ফোর্সের দায়িত্ব পালন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একজন মহান ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন।’
আরেক প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু বলেন, ‘তাজউদ্দীন ছিলেন মেধাবী এবং সর্বোপরি তিনি মানবিক মানুষ ছিলেন। আমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে যখন কলকাতায় যাই। আমাকে দেখে প্রথম তিনি বললেন, “তোমার শরীরটা খারাপ হয়ে গেছে। আগে ডাক্তার দেখাও।” শরীরটা ভালো করতে বললেন। তারপর বাড়ির সবার খোঁজ নিলেন।’
আমু জানান, সত্তরের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু যখন বরিশাল গিয়েছিলেন, তখন তাজউদ্দীন তার সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তখন নির্বাচন করব এ সিদ্ধান্ত তিনিই প্রথম নিয়েছিলেন। তাই তাজউদ্দীন সাহেব তার বক্তৃতায় আমাকে অনেক হাইলাইট করেছিলেন। তা ছাড়া নির্বাচন নিয়ে জটিলতাও তিনি নিরসন করে দিয়েছিলেন।’