তাজউদ্দীন ও সৈয়দ নজরুল : একই পথের পথিক

ফয়সাল আহমেদ |

একজন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, অন্যজন প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অন্যতম দুই কারিগর। তাঁদের জীবনের চলার পথ ভিন্ন স্থান থেকে শুরু হলেও একসময় তাঁরা একই পথে মিলিত হয়েছেন। কী অদ্ভুত! অনেক কিছুতেই দুজনের বেশ মিল ছিল। বাংলার মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। 

তাঁদের যৌথ সংগ্রামী জীবনের যাত্রা শুরু মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ থেকে। রাজপথে মিছিল, মিটিং, লড়াই, সংগ্রাম সবই একসাথে পরিচালনা করেছেন। হাতে হাত ধরে হেঁটেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকার সুবাদেই মুজিবনগর সরকার পরিচালনায় কার্যত কোন সংকট তৈরি হয়নি। 

অথচ সে সময়টা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। দলের মধ্যে উপদল ছিল, কোন্দল ছিল, তার প্রকাশও ঘটেছে। তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে দলের একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনার সময়ে নানা বাধা তৈরি হয়েছে। এসবই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, কারণ সে সময় আপনজনের মতো তাঁর পাশে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

অধ্যাপক অনিসুজ্জামান তাঁর ‘আমার একাত্তর’ বইতে লিখেন- ‘তাজউদ্দীন আমাকে খোলাখুলিই বলেছিলেন যে, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের ব্যাপারে দলের মধ্যে বড়োরকম বিরোধিতা আছে। শেখ মণি যে এরকম একটি বিরোধী গ্রুপের নেতা, তা তিনি আমাকে বুঝতে দিয়েছিলেন, যদিও মনির সঙ্গে আগরতলায় আমার কথোপকথনের বিবরণ আমি কখনো তাঁকে দিইনি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে দলের মধ্যে অন্য গ্রুপও যে সক্রিয়, তা তিনি জানিয়েছিলেন, কিন্তু সে গ্রুপে কারা ছিলেন, তা বলেননি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যে তাজউদ্দীনকে বড়োরকম সমর্থন দিচ্ছেন, একথা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে উল্লেখ করেছিলেন একাধিকবার।’ [ পৃষ্ঠা-৮৭]

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ বইতে লেখেন- ‘খুব নিচু দিয়ে আমাদের বিমান উড়ছে। দু’দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ছোট ছোট বিমানবন্দরে আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বিশেষভাবে খোঁজ করার জন্য ময়মনসিংহ সীমান্তে আমরা খবর দিয়ে রেখেছিলাম। সৈয়দ নজরুলকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটি স্থানে গিয়ে প্রথমে শুনলাম, নেতৃস্থানীয় কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে বিএসএফ-এর স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নিচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। একথা শুনে আমরা ‘ইউরেকা’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে তাঁরা দুজন আসলেন। নজরুল ভাই জিপ থেকে প্রথমে নামেন। ...... সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই ও তাঁর ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে তাজউদ্দীন ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলি তাঁকে অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি।  সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোবারকবাদ জানান। এই দৃশ্য দেখে আমরা সকলেই উৎফুল্ল হই।’ [ পৃষ্ঠা-৪৬]

মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদ এর প্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অব্যাহত সমর্থন অনেক হিসেব-নিকেশ পালটে দেয়। নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রীসভার মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করতেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। যে কারণে বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনেক সহজ ও দ্রত হতো।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি শতভাগ অনুগত এই দুই নেতা, তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে  যুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। কোনোরূপ ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থই বড় ছিল, এই দুই মহান নেতার কাছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন যেখানে তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন,  তাঁরা সেখানেই শতভাগ নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন। 
পরে একসময় বঙ্গবন্ধুর সরকারে তাজউদ্দীন আহমদ অনুপস্থিত থাকলেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন শেষদিন পর্যন্ত। সরকারে না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীন আহমদের আনুগত্যে কোনো ঘাটতি ছিল না। 
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম তাঁর ‘ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ গ্রন্থে লিখেন- বঙ্গবন্ধুর প্রতি শহীদ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানের ছিল অবিচল আস্থা আর আনুগত্য। তা না হলে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকালে আমি যখন টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করলাম ‘আপনারা কি খন্দকার মোশতাকের আহ্বানে সাড়া দেবেন’ তাঁরা সকলে একই উত্তর দিলেন : Over my dead body (আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে)। খন্দকারও এ-কথা জানতেন বলেই ৩ নভেম্বর কেন্দ্রিয় কারাগারে, রাতের অন্ধকারে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটালেন। 
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যোগ দেয়ার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে নানাভাবে ভয় ও প্রলোভন দেখানো হয়। কিন্তু তিনি সে মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন।’ [ পৃষ্ঠা- ৫৫]

এরপর খন্দকার মোশতাক সরকারের নির্দেশে ১৯৭৫ এর ২২ আগস্ট তাজউদ্দীন ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। তাঁদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিউজেলে একসাথে রাখা হয়। খন্দকার মোশতাক তাঁদের অনেকবার তার সমর্থনে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছে। নানা সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু কোন প্রস্তাবেই তাঁরা রাজি হননি। নিজ জীবন বিপন্ন হবে জেনেও মোশতাকের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তাঁরা অবিচল ছিলেন। তারা ইচ্ছে করলেই পারতেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতে, কিন্তু তা করেননি। সদ্য শাহাদাত বরণকারী মহান নেতার রক্তের প্রতি বেঈমানি করার জন্য যে তাঁদের জন্ম হয়নি। তাঁরা জানতেন এবং মানতেন, বঙ্গবন্ধুর নীতি আর আদর্শের সাথে থাকা মানে বাংলাদেশের সাথেই থাকা।

সেদিন এই দুজনের সাথে আরো ছিলেন তাঁদের অন্য দুই সহযোদ্ধা এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় চার নেতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই চার নেতাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। নীতির প্রশ্নে আপোসহীন এই নেতৃবৃন্দ ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়ে শাহাদত বরণ করেছেন।

ফয়সাল আহমেদ : লেখক ও গবেষক। 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022411346435547