বেসরকারি তিন মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম নিবন্ধনে মালিকানাসহ বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া গেছে সোয়া ৫ কোটি ভুল। অপারেটরদের নিজস্ব সার্ভারের তথ্যের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কেন্দ্রীয় বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্ল্যাটফর্মের (সিবিভিএপি) তথ্যে বিস্তর ফারাক দেখা গেছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৯ মাসে নিবন্ধিত সিমে মিলেছে এই গরমিল। সম্প্রতি বিটিআরসির কমিশন বৈঠকে অপারেটরদের সিমের ভুল তথ্য সংশোধনের অনুমতি দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। সোমবার (৮ মে) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায় প্রতিবেদনটি লিখেছেন হাসনাইন ইমতিয়াজ।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, টেলিটক বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় তথ্য না দেওয়ায় তাদের নিবন্ধিত সিমের তথ্যের ভুল সম্পর্কে জানা যায়নি। এ জন্য অপারেটরটিকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপারেটররা সিম নিবন্ধনের সময় যথাযথভাবে তথ্য সংগ্রহ না করায় গরমিল দেখা দেয়। অপারেটররা বলছেন, আঙুলের ছাপের (ফিঙ্গারপ্রিন্ট) সঙ্গে সঙ্গে তাদের গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে কোটি কোটি গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জাতীয় তথ্যভান্ডারে রক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্যের সঙ্গে গরমিল দেখা দেয়। কারও নাম ভুল হয়, কারও ঠিকানা বদলে যায়। একটি মোবাইল অপারেটরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের যদি শুধু আঙুলের মাধ্যমে সিম নিবন্ধন করতে দেওয়া হয়, তাহলে এ ধরনের ত্রুটি কমে আসবে। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্ট জাতীয় তথ্যভান্ডারে রক্ষিত আছে। আঙুলের ছাপ মিললেই বাকি তথ্য জাতীয় তথ্যভান্ডার থেকেই পাওয়া যাবে। এতে গ্রাহক হয়রানি কমবে, নিবন্ধনও সহজ হবে, তথ্যেও গরমিল কমে আসবে। তাঁরা বহুদিন থেকে এই দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে বিটিআরসি তাতে সাড়া দিচ্ছে না।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, এমন অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। নানা জটিলতা সৃষ্টি হবে। তিনি অপারেটরদের সতর্কতার সঙ্গে তথ্য সংগ্রহের পরামর্শ দেন।
আগের ভুল তথ্য সূত্র জানিয়েছে, এর আগেও অপারেটরগুলোর সিম নিবন্ধন-সংক্রান্ত তথ্যে এমন ভুল পাওয়া গেয়েছিল। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জুন পর্যন্ত তিন অপারেটরের সিম নিবন্ধনে ৪ কোটি ৭ লাখ ২৫ হাজার ৪১৮ ভুল চিহ্নিত হয়। বিটিআরসির অনুমোদন নিয়ে এসব তথ্য সংশোধন করে তিন অপারেটর। গ্রামীণের নিবন্ধিত সিমের ভুল পাওয়া যায় ২ কোটি ২৫ লাখ ১৯ হাজার ২১৩টি। সংশোধন করা হয়েছে ১ কোটি ৯৪ লাখ ২৭ হাজার ৫৭৩টি। ৩০ লাখ ৯১ হাজার ৬৪০টি তথ্য সংশোধন সম্ভব হয়নি। বাংলালিংকের ভুল পাওয়া গিয়েছিল ১ কোটি ১২ লাখ ২২ হাজার ৬৯৬টি, সংশোধন হয়েছে ৮৩ লাখ ১৭ হাজার ৫১২টি, সংশোধন হয়নি ২৯ লাখ ৫ হাজার ১৮৪টি। রবির (০১৮ প্রি-ফিক্সের) ৬৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫০৯টি ভুলের মধ্যে সংশোধন করা হয়েছে ৫১ লাখ ১৮ হাজার ৭৬৪টি, অসংশোধিত রয়ে গেছে ১৮ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৫টি। অপারেটরটির ০১৬ প্রি-ফিক্সের অর্থাৎ এয়ারটেলের ২৪ লাখ ৫৭ হাজার ২৫১টি ভুল তথ্যের মধ্যে সংশোধন করা হয়েছে ২৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭০৫টি, সংশোধন সম্ভব হয়নি ১ লাখ ৮ হাজার ৫৪৬টির।
নতুন গরমিল
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত ১৯ মাসে তিন অপারেটরের নিবন্ধিত সিমে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৪৭ হাজার ২৬৩ ভুল পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি গরমিল বাংলালিংকের নিবন্ধিত সিমে, ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬০টি। এর পরই রয়েছে রবি, ২ কোটি ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭৮২টি। গ্রামীণফোনের গরমিলের পরিমাণ ৪৮ লাখ ১৬ হাজার ৭২১টি। মোবাইলের আন্তর্জাতিক পরিচয়-সংক্রান্ত নম্বর (আইএমএসআই) ভুলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, ২ কোটি ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৩২টি। এর পরই আছে নিবন্ধনের তারিখ বিষয়ে তথ্যের ভুল, ১ কোটি ৭৯ লাখ ২৯ হাজার ২৮২টি। আইএস ভেরিফায়েড মিসম্যাচের পরিমাণ ১ কোটি ৪ লাখ ৬ হাজার ৩৫৯টি। এ ছাড়া ডকুমেন্ট আইডি, ডকটাইপ, প্রিপেইড, করপোরেট সিমসহ বিভিন্ন ধরনের গরমিল রয়েছে।
মোবাইল অপারেটরগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি কয়েকটি শর্তে এসব গরমিল সংশোধনের সুযোগ দিয়েছে। এগুলো হলো– সিমের তথ্যের গরমিল নিয়ে বিটিআরসি অর্থ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যেসব তদন্ত করছে, তা চলমান থাকবে। সংশোধিত তথ্যের পাশাপাশি পুরোনো তথ্য (ভুল) সংরক্ষণ করতে হবে। তথ্য সংশোধনের পর কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে তা অপারেটররা পুরোনো তথ্য বিশ্লেষণ করে সমাধান করবে। এ বিষয়ে আইনি জটিলতার দায়ভার অপারেটরদের নিতে হবে। সংশোধিত তথ্যের প্রতিবেদন বিটিআরসিতে জমা দিতে হবে।
বিটিআরসির সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ব্যবহৃত মোবাইল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের ৮ কোটি ৩ লাখ, রবির ৫ কোটি ৫৫ লাখ, বাংলালিংকের ৪ কোটি ১৩ লাখ এবং টেলিটকের ৬৬ লাখ সিম ব্যবহার হচ্ছে।