তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা মাতৃভাষার ক্ষতি করছে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একটা জাতি গঠনের প্রধান উপাদান ভাষা। ধর্মের ভিত্তিতে কখনো জাতি তৈরি হয় না। সেই হিসেবে দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানে পাঁচটি জাতি ছিল। বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধু, বেলুচ আর পাঠান। এই পাঁচটি জাতির একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে কোনো জাতিরই স্বাধীনতা ছিল না। পাঞ্জাবিরা সামরিক বাহিনীতে ছিল। ঐতিহাসিক কারণে ক্ষমতাধর হওয়ায় তারা আধিপত্য বিস্তার করেছিল। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটা কেবল বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না, এটা ছিল জাতিগত মুক্তির আন্দোলন। কারণ, পাকিস্তানটা পাঁচটি জাতির কারাগারে পরিণত হয়েছিল। সেই কারাগার ভাঙার জন্যই আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছি। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ছিল ভুয়া। দুঃখের বিষয়, আমরা বাংলা ভাষার যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলাম, সেখানে বাংলা ভাষার চর্চাটাই ঠিকভাবে করতে পারছি না। বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, মাতৃভাষা চর্চা করতে না পারার কারণ, রাষ্ট্রটা তখন বদল হলেও রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী চরিত্রটা রয়ে গেল। এখানে শ্রেণিবৈষম্য রইল। আর শ্রেণিবৈষম্যের একটা চমৎকার উন্মোচন ঘটছে তিন ধারার শিক্ষার মধ্য দিয়ে, যেখানে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, আবার মাদ্রাসা শিক্ষা আছে। তিন শ্রেণি তিন ধরনের শিক্ষা নিচ্ছে। উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে। তারা বাংলা ভাষাটা ওইভাবে চর্চা করছে না। মধ্যবিত্ত আবার উচ্চবিত্তের অনুকরণ করতে চায়। সে বিশ্ববাজারের দিকে তাকায়। আন্তর্জাতিক হতে চায়। কাজেই সেও মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা বুঝছে না। গরিবরা অশিক্ষার কারণে বাংলা ভাষার চর্চা করতে পারছে না। বিপুলসংখ্যক মানুষ অক্ষরজ্ঞানই অর্জন করতে পারেনি। ধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চা ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। ভাষা ধর্ম বিভাজন, বর্ণ বিভাজন, শ্রেণি বিভাজন মানে না। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে বাস করার কারণে বাংলা ভাষা তো সব জায়গায় যেতে পারছে না। শ্রেণিবিভাজনের ওপর প্রতিষ্ঠিত তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা খুবই ক্ষতিকর।

আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে- রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয়নি। উচ্চ আদালতে এখনো বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষাতে বাংলা থাকলেও গবেষণাগুলো ইংরেজিতেই করি। আমাদের বাংলা ভাষার চর্চা দরকার। চর্চাটা কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হতে হবে তা নয়, সেটা সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, গণমাধ্যমে হবে। কিন্তু চর্চার জন্য আমাদের যে গবেষণার দরকার, যে সাহিত্য সৃষ্টি দরকার সেটা আমরা করতে পারছি না। আমাদের অনুবাদও দরকার। অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ করব, সেই অনুবাদের মধ্য দিয়ে আমাদের ভাষার প্রকাশ ক্ষমতা, ধারণ ক্ষমতা দুটোই বাড়বে। সেটাও করতে পারছি না। সেজন্য আজও বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজকে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলাভাষী। এই বাংলা ভাষার চর্চা হওয়ার কথা বাংলাদেশে, কিন্তু আমরা সেটা করতে পারছি না। আমাদের মানসিকতার মধ্যে থাকা ঔপনিবেশিক আধিপত্যও বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে বাধা। দীর্ঘদিন ইংরেজদের অধীনে ছিলাম। তাই আমাদের মানসিক পরিমন্ডলে ওই ভাষার প্রভাবটা রয়ে গেছে। মনোজগতে ওই ঔপনিবেশিকতা এখনো দূর হয়নি।

আমাদের শিল্প-সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছাতে পারছে না। এ জন্য ভাষাকে দায়ী করা যাবে না। এর পেছনে অন্যতম কারণ আমাদের সেই সৃষ্টিশীলতা নেই। আমরা বিশ্বমাপের গবেষণা করতে পারছি না। অন্যদের আগ্রহী করার মতো বিশ্বমাপের সাহিত্যও সৃষ্টি করতে পারছি না। সেগুলো করতে পারলে এবং তার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহার করলে বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলে যেত। এমনকি আমরা যে আমাদের সাহিত্য যথোপযুক্তভাবে অনুবাদ করে বিদেশিদের কাছে পৌঁছে দেব, সেটাও পারছি না। ব্যর্থতা আমাদের, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির, যারা এই ভাষাটিকে বিকশিত করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। তারা সেই দায়িত্ব পালন করছে না। আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র পুঁজিবাদী। এই পুঁজিবাদের সঙ্গে বিশ্ব পুঁজিবাদের যোগ আছে। আর বিশ্ব পুঁজিবাদের মূল ভাষা এখন ইংরেজি। চীনারা যদি এখানে আধিপত্য করে, তখন দেখা যাবে আমরা চীনা ভাষা শিখছি। ইতিমধ্যে চীনা ভাষা শেখা শুরু হয়েছে। কিন্তু নিজেদের উন্নত করতে চাইলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই করতে হবে। মাতৃভাষা ছাড়া শিক্ষা কখনো গভীর, স্থায়ী ও কার্যকর হয় না।

লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, স্বনামখ্যাত প্রাবন্ধিক ও গবেষক। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ - dainik shiksha বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027790069580078