দলীয় বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশে এই মুহূর্তে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৮, অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যাটি আরো বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ আগেই বলেছিলেন যে প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা তাঁর লক্ষ্য। তাঁর সরকারের আমলেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্রুত বেড়েই চলছে। আগে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেকটাই স্থির ছিল।

সে কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেশের কলেজগুলো এর অধিভুক্ত করা হয় এবং বাছবিচারবিহীনভাবে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম কলেজগুলোতে চালু করা হতে থাকে। আবার নব্বইয়ের দশকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়া শুরু করে। সেটিও এখন শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষার মান এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্পসংখ্যক ছাড়া বাকিগুলোর শিক্ষার মানের আশা করা দুরূহ ব্যাপার। বেশির ভাগই সনদ বাণিজ্যে যুক্ত হয়েছে। বুধবার (১৫ জুন) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক েউপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় শিক্ষার মান ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক উত্থান-পতনের কারণে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়কেই সেশনজটের দীর্ঘ সারিতে আটকে থাকতে হয়েছিল। দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সে কারণে হতাশা বেড়ে যেতে থাকে। আবার বেসরকারি ও সরকারি কলেজগুলোরও অধীনে উচ্চশিক্ষার সুযোগ যেভাবে সম্প্রসারণ করা হয়েছে, তাতে উচ্চশিক্ষার মান এবং গুরুত্ব ওই দুই ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে হারাতে বসেছে। তেমন প্রেক্ষাপটে অপেক্ষাকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই প্রাধান্য পেতে থাকে। সে কারণে শিক্ষার্থীদের ভর্তির প্রথম পছন্দ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি সেটি যদি সবেমাত্র নির্মাণকাজে হাত দিয়েও থাকে। তাহলেও শিক্ষার্থীরা প্রথম বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেই বিবেচনা করে থাকেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার খরচ নিম্নমধ্যবিত্তদেরও নাগালের মধ্যে। তা ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ বা শিক্ষা সেমিস্টার স্বাভাবিক নিয়মে শেষ করা হয়। অপেক্ষাকৃত মেধাবীদের শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি এবং শিক্ষাক্রম ও সহশিক্ষাক্রমে অংশ নেওয়ার পরিবেশ রক্ষা করার চেষ্টা হয়ে থাকে।

কিছুসংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বেশির ভাগেই এসবের অনুপস্থিতি দৃশ্যমান। সরকারি ও বেসরকারি বেশির ভাগ কলেজেই লেখাপড়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এবং উত্তীর্ণ হওয়ার নিয়মটি এগুলোতে এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হতে দেখা গেছে। সে কারণে অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা কলেজ পর্যায়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর শিক্ষায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এর ফলে নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাঁদের আগ্রহ বেড়ে যায়। ভর্তি প্রতিযোগিতা এসব প্রতিষ্ঠানে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যায়। এর ফলে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ভর্তীচ্ছুদের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরামহীনভাবে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই দুরবস্থার কথা বিবেচনা করেই গত চার-পাঁচ বছর থেকে গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তির নতুন নিয়ম চালু হতে থাকে। এটি এখনো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একক পদ্ধতি হিসেবে চালু হয়নি। চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়গুলো বেশ আগেই সফলভাবে এর প্রয়োগ ঘটিয়েছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ বেড়ে চলছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের অর্থে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালিত হওয়ার যে সুযোগ বাংলাদেশে সরকারের শিক্ষা সম্প্রসারণের দৃষ্টি ও নীতিগত কারণে পাচ্ছে—সেটি অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও জাতিকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য ইতিবাচক। বর্তমান বিশ্বে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং উচ্চ দক্ষ জনশক্তি গঠন করা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে উন্নয়নশীল ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া মোটের ওপর অসম্ভব ব্যাপার। 

আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক এবং অন্যান্য স্তরের শিক্ষার মানও আশানুরূপ নয়। সে কারণে বেকার কিংবা অদক্ষ জনগোষ্ঠীর তালিকায় এ ধরনের সনদধারীদের ব্যাপকভাবে দেখতে হয়। ফলে দেশের শিল্প, কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনসহ সর্বত্র মানসম্মত শিক্ষালাভকারী দক্ষ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর ফলে সমাজের সর্বত্র চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতি, অসৎ প্রতিযোগিতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তরুণদের একটি বড় অংশ স্থানীয় নানা ধরনের প্রভাবশালী, দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতিতেও এসব কিশোর-তরুণকে লাঠিয়াল কর্মী এবং হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে। অথচ মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে এসব শিশু-কিশোর স্কুল কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অতিক্রম করতে সক্ষম হলে তারা দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে দক্ষ, মেধাবী এবং যোগ্য মানবসম্পদ হিসেবে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারত। দেশ তাতে লাভবান হতে পারত। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় মানের বৈষম্য ব্যাপকতর হওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মানসম্মত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য খুব একটা যোগ্য হয়ে ওঠে না।

আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও মানের বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। ধনী গোষ্ঠীর বড় অংশের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আরেকটি অংশ অভিজাত কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তবে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যালগুলোয় ভর্তির সুযোগ পেয়ে পড়াশোনা করছেন। সমাজের বাকি সব স্তরের মেধাবী এবং অপেক্ষাকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা সব কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী। অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁদের এই অবস্থান গ্রহণ। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, যোগ্য মেধাবী শিক্ষক, ল্যাব, লাইব্রেরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য বিরাজ করছে। বেশ কয়েকটি পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষকদের নানা ধরনের শিক্ষাবহির্ভূত অগ্রহণযোগ্য ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার যেমন অভিযোগ রয়েছে, একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনাধুনিক রাষ্ট্র রাজনৈতিক চিন্তায় বিশ্বাসী শিক্ষকের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণাগত মানদণ্ডটি চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, দলীয় বিবেচনায় অনেক অযোগ্য এবং কমযোগ্য শিক্ষকের নিয়োগ ঘটেছে। যাঁরা বর্তমান দুনিয়ার খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে মোটেও পরিচিত নন। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজমান দলীয় বিবেচনা থেকে ক্রমাগতভাবে সহজীকরণ করা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গুণগত মান যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না, নানা ধরনের মানহীন প্রকাশনা এবং তদবির, দলীয় প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের সংখ্যাধিক্য ঘটলেও দেশে বা বিদেশে গবেষণার খ্যাতি রয়েছে এমন শিক্ষকের সংখ্যা হাতে গোনার পর্যায়ে নেমে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে একুশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন চিন্তা ও গবেষণাকে যুক্ত করার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ ও বিনিয়োগ থাকা দরকার সেটি খুব একটা হচ্ছে না। নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে, কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। বিদেশে আমাদের অনেক খ্যাতিমান শিক্ষক ও গবেষক রয়েছেন। তাঁদের আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারত। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উন্নত দুনিয়ার মতো শ্রেণিপাঠ, গবেষণা, লাইব্রেরি, সেমিনার এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন নতুনভাবে পরিকল্পনা করা। ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাই নতুন দুনিয়ার উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো করে ভাবতে হবে।

লেখক : মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040419101715088