দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য শিক্ষা

মাছুম বিল্লাহ |

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৪ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস পালিত হবে, এটি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বরের ঘটনা। সেই থেকে প্রতিবছরই নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস’। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো প্রতিবছর দিবসটি পালন করে আসছে। এবার ‘দীর্ঘমেয়াদি শান্তির জন্য শিক্ষা’ স্লোগান দিয়ে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ‘অন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস’ পালনাকালে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বলেছিলেন, একমাত্র শিক্ষাই  ব্যক্তির জীবন বদলে দিতে পারে। মালালা ইউসুফজাই বলেছিলেন ‘একটি বই, একজন শিক্ষক ও একটি পেন বিশ্বকে বদলে দিতে পারে’। আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবসে নেলসন ম্যান্ডেলার উক্তিও আমরা স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, ‘একমাত্র শিক্ষাই হচ্ছে বিশ্বকে বদলানোর মোক্ষম অস্ত্র।’

মূলত শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে ও শিক্ষাকে বিশ্বশান্তি রক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে শিক্ষাকে কাজে লাগানোর প্রত্যয়ে এই দিবসটি পালিত হয়। ‘দীর্ঘ মেয়াদী শান্তির জন্য শিক্ষা’ –এবারকার প্রতিপাদ্য, পূর্ববর্তী বছরগুলোর প্রতিপাদ্য -- জনমানুষ, ধরিত্রী, সমৃদ্ধি ও শান্তির জন্য শিক্ষা।’ পরিবর্তনশীল গতিপথ, রূপান্তরিত শিক্ষা। এগুলো সবই শিক্ষার বিস্তার, শিক্ষাকে মানব কল্যাণে ও সমৃদ্ধিতে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর প্রত্যয়ের কথা বলে। 

শিক্ষাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, সব স্তরের মানুষকে শিক্ষায় অন্তর্ভূক্ত করতে এবং শিক্ষার্থীদের ড্রপআউট কমাতে এই দিনটিতে নতুন করে শপথ নিতে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরে। শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে প্রাসঙ্গিকতা ও সমতার ভিত্তিতে অর্থাৎ শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে প্রাসঙ্গিকভাবে। যেমন আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। তার অর্থ হচ্ছে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হবে। সাধারণ শিক্ষা এমন মানের হতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা সমাজের ও রাষ্ট্রের বোঝা না হয়। শিক্ষার এই সুযোগ অঞ্চল থেকে অঞ্চলে, শহর থেকে গ্রামে, সমতল ভূমি থেকে পাহাড়ী জনপদে যে পর্বতসম পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটিকে সমতায় নিয়ে আসার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের। সেই আলোচনা, প্রস্তাবনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের দিন আজ। শুধু বক্তব্য দেয়ার দিন নয়।  

করোনা মহামারীতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষককূল যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তা পুষিয়ে তাদের নতুন স্বপ্ন দেখানোর উদ্দেশ্যেও দিবসটিতে অনেককিছু করণীয় আছে। একদেশ থেকে আরেক দেশের পদক্ষেপ ও বাস্তবতা ভিন্ন কিন্তু শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে সর্বত্রই। তাই কোথায় কি ব্যবস্থা নিলে তারা বিশ্বের ভবিষ্যত কার্যকরী নাগরিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সে ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো এবং কার্যকরী উদ্যোগ যাতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো গ্রহণ করে --সেটিও দিবসটি পালনের একটি উদ্দেশ্য। একইসঙ্গে শিক্ষকরাও কিন্তু কোভিডকালীন সময় তাদের দক্ষতার প্রয়োগ করতে পারেননি। তারা সেই ক্ষতি পুষিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় এবং রূপান্তরিত শিক্ষায় নিজেদের কিভাবে নিয়োজিত করতে পারেন সেটির করণীয় ঠিক করার দিনও আজ। 

গ্রামে ও শহরে বাংলা মাধ্যমের স্কুলশিক্ষা সংকোচনের সঙ্গে যেসব আর্থ সামাজিক বাস্তবতা জড়িত, সেগুলোকে আমলে নিতে হবে। গ্রামে অধিক হারে শিক্ষার্থী মাদরাসায় যাচ্ছেন আর শহরে যাচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যমে। 

শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত ও বস্তিবাসী সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এমনিতেই নিম্নবিত্তের জনপরিসরে এ ধারণা গেঁথে গেছে, সাধারণ মানের শিক্ষা চাকরির নিশ্চয়তা দেয়না বলে স্কুল-কলেজে গিয়ে কোনো লাভ নেই। যেহেতু দাখিলও নতুন কারিকুলামের আওতাধীন, তাই তামিরুল মিল্লাতের মতো যেসব মাদরাসা অনেক ভাল করছিলো তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইংরেজি আর কওমিতে একচেটিয়া শিক্ষার্থী বাড়বে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল খুঁজছেন, যাতে সামনের বছর সন্তানকে সেখানে দিতে পারেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা বিপদের মধ্যে আছেন। 

ক্রমাগত পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছেই, যেমন জিপিএ গ্রেডিং সিস্টেমে পরিবর্তন, প্রাইমারি-নিম্নমাধ্যমিকে পাবলিকে পরীক্ষা একবার শুরু করে আবার বন্ধ করা, সৃজনশীল ঢুকিয়ে পরে বন্ধ করা, শিক্ষক প্রস্তত না করেই সৃজনশীল সিলেবাস ঢোকানা। এসএসসিতে অটোপাস, আবার এসএসসি বন্ধের উদ্যোগ, এইচএসসিতে অটোপাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষায় সহজ প্রশ্ন, বেশি পাস দেখাতে উদার মুল্যায়ন—এসবের পাশাপাশি প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা তো অহরহ ঘটছেই। 

শিক্ষা নিয়ে শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি ছাড়া কিছুই দিচ্ছেনা। এমনিতেই শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে চায়না, আসলে কোনো কাজ একটু কঠিন হলে, একটু পরিশ্রমের হলে করতে চায়না তার পর নেই কোন ধরনের চাপ, পরীক্ষা। দু’চারটি ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বাংলা দেখে ভালোভাবে পড়তে পারেনা, ইংরেজি পড়াতো দূরের কথা। এটি বানানো কথা নয়, আমি নিজে দেখেছি। নিজ বইয়ের একটি অধ্যায়ের নামও বলতে পারেনা। এ অবস্থা চলছে বহুদিন থেকে। এর পরিবর্তন দরকার ছিলো। কিভাবে তাদেরকে বই পড়াতে হবে, কিভাবে তারা দুটি বাক্য নিজে লিখে যেকোনো বিষয় বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বুঝতে পারবে। পড়াতে হলে শিক্ষকদেরও তো আনন্দ থাকতে হবে, তা না হলে শিক্ষার্থীরা আনন্দ পাবেন কিভাবে? এ বিষয়গুলো চিন্তা করার দিন আজ। 

জাতিসংঘের গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট উল্লেখিত পিইইআর ব্যবস্থাকে প্রায়োগিক স্তরে কাজে লাগানোর ব্যাপারে শিক্ষকমন্ডলী ও যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন তাদেরকে সহায়তা করা দিবসটি পালনের আর একটি মোক্ষম উদ্দেশ্য। লিঙ্গ বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে ব্যক্তিগত সামর্থ্যকে ও শক্তিকে কাজে লাগানো, রাজনৈতিকসহ সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে শিক্ষাকে সর্বজনীন করার একটি প্রয়াস হচ্ছে দিবসটি পালন। সভ্যতা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষকমন্ডলীকে সেভাবে তৈরি করা ও শিক্ষাদান করার জন্য নিয়োজিত করা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কর্মসূচির সাফল্যসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য, বিশেষ করে ৪নং লক্ষ্য ও উল্লেখযোগ্য নানা আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের মূল্যায়নের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন এ দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। 

দিবসটি পালনের আরো একটি উদ্দেশ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পড়াশোনায় জোর দেয়া, ডিজিটাল সুবিধা সর্বত্র পৌঁছে দেয়া। শিক্ষা সবার জন্য, শিক্ষা সবার অধিকার। এটি শুধু খাতা কলমে থাকলে হবেনা। অনেক শিশু এখনও একমাত্র অসচ্ছলতার কারণে তাদের মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পৃথিবীতে নিরক্ষরতা যত, দারিদ্র্যের হারও ততো। তার মানে হচ্ছে দারিদ্র্যতা শিক্ষা গ্রহণ ও বিস্তারের এক বিশাল অন্তরায়। সেটিকে কিভাবে উতরে যাওয়া যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রগুলোকে বাস্তবমূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধী, নারী, পিছিয়ে পড়া জনপদের জনসংখ্যার জন্যও সুষম শিক্ষা যাতে নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা, সচেতনতা ও পদক্ষেপ জরুরি। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, লিড- এডুকেশন অ্যান্ড রিচার্স, দৈনিক শিক্ষাডটকম


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068109035491943