দুই শিফটের স্কুলে প্রধান শিক্ষক একমাত্র ভরসা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

পাড়ার একপাশে বিশাল দালানঘর। নতুন রঙের প্রলেপ দেয়ালজুড়ে। বারান্দা ও গেটে লোহার গ্রিল দিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা সুরক্ষিত। ছাত্র-ছাত্রীরাও স্কুলে আসে নিয়মিত। শুধু পাঠদান হয় না। ঘণ্টাখানেক ঘোরাফেরা করে কোনো ধরনের লেখাপড়া ছাড়াই বাড়ি ফিরে যেতে হয় কোমলমতি শিশুদের।

উসাইওয়ং পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা। ক্লাস হবে—এই আশায় প্রতিদিনই সে স্কুলে ছুটে আসে। কিন্তু ক্লাস আর হয় না। প্রতিদিন লেখাপড়া না করেই অন্যদের সঙ্গে ফিরে যেতে হয়। এত তাড়াতাড়ি ফিরে যাচ্ছ কেন—এমন প্রশ্নে শিশুটি মুখ কালো করে বলল, ‘হেডমাস্টার স্যার আজ আসেননি। তাই আজও ক্লাস হবে না।’ অন্য শিক্ষকরা কোথায় জানতে চাইলে ওর সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘জানি না। স্যাররা অনেক দিন ধরে স্কুলে আসেন না।’ সে জানায়, হেডস্যার থাকলে কোনো দিন বাংলা, কোনো দিন ধর্ম, কোনো দিন সমাজ পড়ানো হয়। বছর শেষ হতে চললেও ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত এসব বিষয়ে এখনো হাত দেওয়া হয়নি।

বান্দরবানের রুমা উপজেলার বটতলি গ্রামে অবস্থিত সেংগুমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ মোট শিক্ষক পদের সংখ্যা চার। তাঁদের মধ্যে ‘কর্তার ইচ্ছায়’ একজনকে ডেপুটেশনে রাখা হয়েছে উপজেলা সদরে, একজন আছেন বিপিএড প্রশিক্ষণে, তৃতীয়জন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। এখন সেংগুম ঝিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিসহ ছয়টি ক্লাসের পাঠদান একমাত্র প্রধান শিক্ষকের ওপর ভর করে চলছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অঞ্জন বড়ুয়া জানান, দুই শিফটের এই বিদ্যালয়ে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিভাগীয় কাজ, মাসিক সভা, ক্লাস্টার ট্রেনিং, প্রাপ্য ছুটি কাটানো এবং বিভিন্ন দিবস পালনের জন্য এলাকার বাইরে থাকতে হয় তাঁকে। অন্য কাজে সময় দেওয়ার পর ফুরসত পেলেই তিনি মাঝেমধ্যে স্কুলে আসেন এবং ক্লাস নেন। বাকি দিনগুলো আড্ডায় আড্ডায় কাটায় শিক্ষার্থীরা।

প্রধান শিক্ষক জানান, গত বছরের ২৩ মার্চ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লিখিত নির্দেশ পেয়ে উপজেলা সদরের ঘোনাপাড়ায় চলে যান সহকারী শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন। ১ জানুয়ারি বিপিএড প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান হ্লামংসিং মারমা। ২৩ জুন থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন মায়উ মারমা। তাই এখন তিনি একই সঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, এমনকি দপ্তরিও। এ অবস্থায় চলতি বছরে সাতজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। তাদের নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা। ভীষণ চিন্তায় পড়েছেন তিনি নিজেও।

অঞ্জন বড়ুয়া বলেন, ‘অতীতে এই স্কুলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার ছিল শতভাগ। ২০১৬ সালে ১০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবাই পাস করে। পরের বছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা সাতে নেমে এলেও সবাই ভালো ফল করে। কিন্তু শিক্ষক সংকটের কারণে এবার কী হতে যাচ্ছে নিজেও জানি না।’

পাড়াপ্রধান (কার্বারি) থোয়াই চিং মারমা জানান, ১৯৬৫ সালে রুমা সেনানিবাসসংলগ্ন সদরঘাট এলাকায় সেংগুমপাড়ায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর পাশের এলাকা বটতলায় সেংগুমপাড়া স্থানান্তরিত হলে বিদ্যালয়টিও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্কুলের ফল বরাবরই ভালো ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক সংকটে স্কুলের সামগ্রিক শিক্ষার মান নিচে নেমে গেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অবিবেচকের মতো কাউকে প্রশিক্ষণে, কাউকে ডেপুটেশনে দিয়ে স্কুলটিকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানানো হয়েছে। অবিলম্বে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদায়ন করে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার দাবি আমাদের।’

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্কুলবিহীন গ্রামে এক হাজার ৫০০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন কর্মসূচির আওতায় রুমা উপজেলার ভরতপাড়া, প্রংফুংমক খুমিপাড়া, মেনরনপাড়া, পলিতং-বেথেলহেমপাড়া, ম্রক্ষ্যংপাড়া এবং ঘোনাপাড়ায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। পিইডিপি-২ কর্মসূচির আওতায় পাঠদানের জন্য সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি বহুতল ভবনও নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নবপ্রতিষ্ঠিত এই ছয় বিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষক পদায়ন করা হয়নি। অন্য স্কুল থেকে একজন শিক্ষককে ডেপুটেশনে সংযুক্তি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

রুমা উপজেলা চেয়ারম্যান অং থোয়াই চিং মারমা জানান, পুরো উপজেলাতেই শিক্ষক সংকট রয়েছে। এ কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক পদায়নের জন্য বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে বারবার ধরণা দিয়েও ইতিবাচক ফল মিলছে না। তিনি আরো জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিজ নিজ পার্বত্য জেলা পরিষদে ন্যস্ত করা হয়েছে। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হবে না।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই - dainik shiksha একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043399333953857