চলতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় বসা দুই সহস্রাধিক পরীক্ষার্থী প্রথমে ফেল করলেও খাতা চ্যালেঞ্জ বা ফল পুনর্নিরীক্ষণে পাস করেছেন। গত ২৮ জুলাই পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকে ওই ২ হাজার ২৮৬ জন শিক্ষার্থীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো। কারণ, আশানরূপ পরীক্ষা দিলেও তাদের ফেল দেখানো হয়েছিলো। তবে, খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করে তারা পাস করেছেন। তবে, ফল প্রকাশের পর একটি মাস তাদের সইতে হয়েছে অবহেলা-কটূক্তি। কারণ, শিক্ষা বোর্ডগুলোর পরীক্ষক ও নিরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা তাদের খাতার নম্বর গুণতে ভুল করেছেন।
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের এক মাস পর গতকাল সোমবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, রাজশাহী, যশোর, সিলেট ও দিনাজপুর বোর্ড এসএসসি, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড দাখিল ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ বা পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করে।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলে ফেল করার পর খাতা চ্যালেঞ্জ করে ২ হাজার ২৮৬ জন শিক্ষার্থী পাস করেছেন। তদের মধ্যে ছয়জন সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন। আর নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৬২৮ জন পরীক্ষার্থী।
ফেল করার পরেও পাস করা বা জিপিএ-৫ পাওয়া নিয়ে পরীক্ষার্থীরা খুশি হলেও অভিভাবকরা দুষছেন পরীক্ষক ও নিরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের। তারা বলছেন, উত্তরপত্র নিরীক্ষকদের দায়িত্ব অবহেলায় প্রথমে খারাপ করা এসব শিক্ষার্থীকে একটি মাস প্রচণ্ড মানসিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হয়েছে। তারা সংশ্লিষ্ট পরীক্ষক ও নিরীক্ষদের শাস্তি চেয়েছেন। এদিকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, কৈশোরে শিক্ষার্থীদের এমন চাপে ফেলা কখনোই কাম্য নয়, বিষয়টি খতিয়ে দেখে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা বোর্ডগুলো বলছেন, পরীক্ষক নিরীক্ষকদের সতর্ক করার পরও এমনটা হচ্ছে, আগামীতে তাদের পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া হবে। দোষী শিক্ষকরা আর সুযোগ পাবেন না।
অভিভাবকরা বলছেন, খাতা পরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতায় শিশুদের ভোগান্তি হয়েছে। বাচ্চারা এতোদিন জানতেন ফেল করেছেন, এখন দেখা যাচ্ছে আসলে পাস করেছেন। তারা একটি মাস অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণায় কাটিয়েছেন। এটি কখনোই কাম্য না। কোনো শিক্ষার্থীর এ ধরনের যন্ত্রণায় থাকা উচিত নয়। যেসব শিক্ষক খাতা দেখে পরীক্ষার্থীদের ফেল করিয়েছিলেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ওই অভিভাবক। তার মতে, এসব পরীক্ষক ও নিরীক্ষকদের খাতা দেখার দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া উচিত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন গতকাল সোমবার রাতে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, শিশুদের সঙ্গে এমনটা হওয়া কখনোই কাম্য নয়। কৈশোরে একটি বাচ্চার ওপর এ ধরনের চাপ আসা একদম উচিত না। এসব দিকে শিক্ষকদের যেমন নজর দিতে হবে, অভিভাবকদেরও নজর দিতে হবে। যদি শিক্ষকদের গাফিলতিতে এমনটি হয় তবে অবশ্যই উচিত ওইসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। যেসব শিক্ষক খাতা দেখতে বা গুণতে ভুল করেছেন তাদের এ দায়িত্ব থেকে বাদ দিতে হবে।
এদিকে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মোর্চা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার গতকাল সোমবার রাতে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক। খাতা দেখতে বা গুণতে ভুল করা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের আর সুযোগ দেয়া হবে না। তাদের পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে আজীবনে জন্য অব্যাহতি দেয়া হবে। তাদের চিহ্নিত করে আমরা বোর্ডে নোটিশ দেবো। তারা বোর্ডের কোনো পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
বোর্ডগুলো থেকে প্রকাশিত এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষার ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঢাকা বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ১০৪ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩৬২ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের মোট ৩ হাজার ৮৫ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। তবে ফেল করা কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাননি। এ বোর্ডের ৭৩ হাজার ৪৬ পরীক্ষার্থী ১ লাখ ৯১ হাজারটি খাতা পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেছিলেন।
কুমিল্লা বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ১৭৯ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯৪ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডে ফেল করা ২জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। গত ২৮ জুলাই প্রকাশিত ফলে দেখা যায় ওই দুই শিক্ষার্থীর একজন গণিতে ও অপরজন পদার্থবিজ্ঞানে ফেল করেছিলেন। তবে চ্যালেঞ্জ করে তারা ওই দুইটি বিষয়ে পাস করেছেন। ফলে আগে ফেল করলেও তার সার্বিক ফল বা গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (জিপিএ)-৫ এসেছে। ফেল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া ওই দুই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর ২০৮৮২৭ ও ২০১৮০১। এ বোর্ডের মোট ৮৭৯ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে।
চট্টগ্রাম বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ১৩০ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৬২ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের মোট ১ হাজার ৮০ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে।
খাতা পুনর্নিরীক্ষণে দিনাজপুর বোর্ডে দিনাজপুর বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৭৫ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭৩ জন পরীক্ষার্থী।
বরিশাল বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৩ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৯ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের মোট ১৭১ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে।
ময়মনসিংহ বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৮৭ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৫১ জন পরীক্ষার্থী।
যশোর বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৫৪ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫২ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের মোট ৫৩৪ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণে যশোর বোর্ডে ফেল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনজন পরীক্ষার্থী। গত ২৮ জুলাই প্রকাশিত ফলে তাদের একজন ব্যবসায় উদ্যোগে, একজন পদার্থবিজ্ঞানে ও অপরজন গণিতে ফেল করেছিলেন। কিন্তু ফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করে তারা ওইসব বিষয়ে পাস করেছেন। ফলে আগে ফেল করলেও তার সার্বিক ফল বা গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (জিপিএ)-৫ এসেছে। ফেল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া ওই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর ১১২৩৪৪, ১২২৫৩০ ও ৪১৭৬৭৪।
রাজশাহী বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৪১ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৯ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের মোট ৮৭৯ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। গত ২৮ জুলাই প্রকাশিত ফলে দেখা যায় বিজ্ঞান বিভাগের ওই শিক্ষার্থী রসায়নে ফেল করেছিলেন। তবে রাসায়ন খাতা চ্যালেঞ্জ করে তিনি রসায়নে এ প্লাস পেয়েছেন। ফলে আগে ফেল করলেও তার সার্বিক ফল বা গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ (জিপিএ)-৫ এসেছে। ফেল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া ওই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর ১৪৯৫১৫।
সিলেট বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৭৯ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪৯ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের মোট ৪৭২ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে।
দাখিল পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণে ফেল থেকে পাস করেছেন ১ হাজার ৫৩৪ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৯৭ জন পরীক্ষার্থী। মোট ৪ হাজার ১৯৫ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে।
এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা হলেও এর পরিসংখ্যান জানানো হয়নি। বোর্ডের কর্মকর্তারা দৈনিক আমাদের বার্তা বলেন, ফেল থেকে কতোজন পাস করেছেন ও কতোজন জিপিএ-৫ পেয়েছেন সে হিসেব তাদের কাছে নেই।