দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন, দুর্নীতিবাজদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রধান করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে অতিথি করে প্রথম সারিতে বসানো হচ্ছে। নাগরিকরাই দুর্নীতিবাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল সকালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) আয়োজিত দুর্নীতি দমনে নাগরিকদের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতিকে কেউ সমর্থন করে না। আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ হন তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে আপনিও দুর্নীতিকে সহায়তা করছেন। এ বিবেকটা জাগ্রত করতে হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আপনার পাশের বাসায় ইলিশ মাছ ভাজে আপনি সেটার ঘ্রাণ পান না? আপনার পাশের বাসার লোকটা যদি দুর্নীতি করে আপনি টের পান না? আপনার কি কিছুই করণীয় নেই। আপনি কেবল দুদকের সমালোচনা করছেন। আপনার বাসার ভাড়া ৫০ হাজার টাকা অথচ যার বেতন ২০-৩০ হাজার টাকা তাকে বাসা ভাড়া দিচ্ছেন কেন। নাগরিকদের কি কিছুই করার নেই। কিছু করার না থাকলে বর্জন তো করতে পারি।
মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, এখানে নাগরিকদের ভূমিকা নয়, দুর্নীতি দমনে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুর্নীতি বলতে আমরা বুঝি কেবল সরকারি কর্মকর্তারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এটা ইচ্ছাকৃতভাবে বলা হয় কি না, শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কথা বলে অনেকেই প্রকাশ্যে যা খুশি তাই করা যায় এটাও দেখা দরকার। শিডিউলভুক্ত অপরাধ নিয়ে দুদক কাজ করে। তিনি বলেন, টোল ফ্রি নম্বরে যেসব অভিযোগ আসে তার ৯০ শতাংশই আমাদের তফসিলবহির্ভূত। অভিযোগ অনুসন্ধান করে তারপর আমলে নিতে হয়। দুদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বলেন, কথা বলা খুব সোজা। কাজ করা কঠিন।
ডিসিদের তারা পাত্তা দেয় না। ডিসিরা মুভ করতে পারে না। এমন ঘটনাও আমরা জানি। অনেক উপজেলায় একদম একনায়কতন্ত্র শাসন চলে। কিছু কাগজপত্রের ওপর নির্ভর করে দুদক মামলাটি কোর্টে নেবে। এখানে স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পারায় দুদক প্রকৃত ঘটনা বের করতে পারে না। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সাবেক এমপি ব্যারিস্টার শামিম হায়দার পাটোয়ারী এবং সিনিয়র সাংবাদিক জ ই মামুন। ব্যারিস্টার শামিম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, দুর্নীতির ছোট ঘটনা তদন্ত না করে বড় ঘটনা তদন্ত করা প্রয়োজন। ব্যাংক লোনের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে কতিপয় প্রভাবশালী সবচেয়ে বড় দুর্নীতির ঘটনা সৃষ্টি করেছেন। জ ই মামুন বলেন, কতিপয় ক্ষেত্রে মিডিয়াগুলো দুর্নীতি প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। কারণ ঢাল তলোয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বিদ্যমান। প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে সাংবাদিকরা অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্টিংয়ে ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছেন। সেমিনারে দুদকে কর্মরত সবার সম্পদের হিসাব দুই বছর পরপর জনগণকে অবহিত করার জন্য সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করাসহ ১৯টি সুপারিশ দিয়েছে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। সুপারিশগুলো হলো- কমিশনের সদস্য সংখ্যা সাতজন ও কর্মরত লোকবল সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। দুদকের চেয়ারম্যান, কমিশনার ও কর্মকর্তাদের নির্দলীয় মনোভাব, সাহসী ব্যক্তিত্ব এবং দুর্নীতি থেকে দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। দলমত, পেশা, এলাকা এবং ব্যক্তি পরিচিতি সব আইন প্রয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া কমিশনের প্রত্যেক মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে দুদকের আইন ও বিধি সুনির্দিষ্টভাবে অনুসরণ করতে হবে। ব্যত্যয় ঘটলে কমিশন কর্তৃক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হলে সেক্ষেত্রে অনুসন্ধান, তদন্ত দ্রুত সময় শেষ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
দুদকে ডেপুটেশনে পদায়নের ক্ষেত্রে তাদের চাকরি দুদকে ন্যস্ত করার বিধান করতে হবে। দুদকে চাকরিরত অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তদন্ত ও শাস্তি, দুদক আইনে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন রিপোর্টে বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিষয়ে বলা হচ্ছে। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সেসব রিপোর্ট সম্পর্কে দুদককে তদন্ত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তাদের বিষয় দুদকের তদন্তের পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তাৎক্ষণিক তদন্ত থেকে বিরত রাখা নিশ্চিত করতে হবে। অধিক গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গণমাধ্যমে প্রচারিত অনুসন্ধানী রিপোর্ট দুদককে সরাসরি অনুসন্ধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুদকে মামলার পর আসামিকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দ্রুত সময়ে মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত সমাপ্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং যারা তা করতে পারবেন তাদের পুরস্কৃত করতে হবে। কোটি টাকার ওপরে দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ওপরে গোয়েন্দা নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে তিনি প্রভাবিত না হতে পারেন। বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য অধিক সংখ্যক দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোনো আইনজীবী আসামিপক্ষ থেকে প্রভাবিত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্য থেকে দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পুরস্কার দিতে হবে। যেসব অনুসন্ধান, তদন্ত এক বছরের মধ্যে শেষ হচ্ছে না সেগুলো তালিকাভুক্ত করে কমিশনের তত্ত্বাবধানে দ্রুত শেষ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিদেশে অর্থ পাচার বা ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের তথ্য দুদকের কাছে এলে বা মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে কমিশনকে গুরুত্ব সহকারে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের ভ্রমণ, গাড়ি ব্যবহার, ব্যাংক লেনদেন বন্ধ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি বিধান সংযোজন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনেক দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে অনুসন্ধান না করায় ঢালাওভাবে অব্যাহতি পেয়েছেন এবং এ বিষয়ে মিডিয়ায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে মিডিয়ার তথ্য বিবেচনায় নিয়ে অব্যাহতিপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালীদের বিষয় পুনরায় অনুসন্ধানের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।