দুর্নীতিবাজ উপাচার্যদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উপাচার্যকে (উপাচার্য) প্রায়ই জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম হতে দেখা যায়। এজন্য নয় যে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে খুব ভালো অবদান রাখছেন বরং তাদের কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বদনাম হচ্ছে, শিক্ষার গুণগতমান তলানিতে যাচ্ছে। উপাচার্যদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়ে এমন কোনো নেতিবাচক বিশেষণ বাকি নেই, যা পত্রিকায় প্রকাশ হয়নি। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের থামানো যাচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির নির্দেশনাও মানছেন না উপাচার্যরা। তাহলে প্রশ্ন হলো দুর্নীতিবাজ এসব উপাচার্যকে রুখবে কে? সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, দেশে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন বা সংবিধি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপাচার্যের মহান দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বা সংবিধিকে সমুন্নত রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বা সংবিধিতে উপাচার্যদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা স্পষ্টায়ন করা থাকে। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এজন্য যে, এখানে যারা প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন তারা হবেন শিক্ষক, যাদের জাতির বিবেক ধরা হয়। ধরে নেওয়া হয় যে, একজন শিক্ষক কোনোমতেই বিবেকবর্জিত হবেন না। একজন শিক্ষক কখনোই অনিয়ম এবং দুর্নীতির সঙ্গে আপস করবেন না। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, অনেক উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে আইন বা সংবিধিকে সঠিকভাবে মানছেন না বরং প্রদেয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের সুবিধামতো নতুন নতুন আইন তৈরি করছেন ও তার প্রয়োগ করছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি ব্যাপক হারে বেড়েই চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবলে উপাচার্যদের হাতে প্রভুত ক্ষমতা থাকায় তারা যা ইচ্ছা তাই করছেন এবং তা বৈধ করে নিচ্ছেন সিন্ডিকেট/রিজেন্ট বোর্ডের মাধ্যমে। অধিকাংশ সিন্ডিকেট/রিজেন্ট বোর্ডের সদস্যরা উপাচার্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পছন্দ করেন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট/রিজেন্ট বোর্ডে সরকারি আমলা, জনপ্রতিনিধি (সংসদ-সদস্য), ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল প্রফেসর, শিক্ষাবিদ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে অনেককেই কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। অনেক সিন্ডিকেট/রিজেন্ট বোর্ড মেম্বার নিজস্ব স্বার্থে ও কারণে (চাকরি, টেন্ডার) চুপ থাকেন। অবশ্য কেউ কেউ চেষ্টা করেন; তা না হলে উপাচার্যরা হয়তো আরও বেপোরোয়া হতেন। বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে অনিয়ম হতে দেখা যায়, তার মধ্যে বেশির ভাগই উপাচার্যের পারসোনাল ইন্টারেস্টের কারণেই হয়। উপাচার্যরা নীতিনৈতিকতা ভুলে গিয়ে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ ভুলে যান।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন বা উপাচার্যদের অপসারণ/পদত্যাগ দাবি একটি প্রচলিত আন্দোলন। একসময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা একসঙ্গে বা আলাদা করে আন্দোলনের মাধ্যমে উপাচার্য অপসারণ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করত। আন্দোলনের মাত্রা বা ভয়াবহতা চিন্তা করে সরকার তখন উপাচার্য অপসারণ করত। বাংলাদেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী এ ধরনের প্রচলিত আন্দোলন একটি ধারায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ ধরনের আন্দোলন হলেও সরকার সহজে উপাচার্য অপসারণ করতে চায় না। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থিতিশীল রাখার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে লক্ষণীয়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌক্তিক আন্দোলন হলেও উপাচার্য পরিবর্তন হচ্ছে না বরং সরকারের পক্ষ থেকে যেভাবেই হোক উপাচার্যকে বহাল রেখেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের দুর্নীতির কারণে অনেক সময় তদন্ত কমিটি হয়; কিন্তু দুর্নীতিবাজ উপাচার্যদের শাস্তি হয় না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা ধরে নিয়েছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন বা তদন্তই হোক না কেন, তাদের কোনো কিছুই হবে না। কোনো কোনো উপাচার্য এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চরম স্বেচ্ছাচারিতা করে যাচ্ছেন, বিভিন্ন ধরনের অন্যায়, অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। সরকার যে উদ্দেশ্যে উপাচার্যদের সমর্থন দেন, উপাচার্যরা তার সঠিক ব্যবহার করছেন না।

বর্তমানে অনেক উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকমতো কাজ করছেন না বা তাদের সঠিকভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। উপাচার্যবলয় উপাচার্যদের ভুল পথে পরিচালিত করছেন। উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ/সুযোগ-সুবিধা এবং একাডেমিক দিকগুলোয় গুরুত্ব দিচ্ছেন কম। বরং নিয়োগ, টেন্ডার, নতুন উন্নয়ন প্রকল্প ইত্যাদি কাজে বেশি আগ্রহ দেখান। উপাচার্যরা নিজেদের অন্যায়-অনিয়ম ঢাকতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। কিছু কিছু উপাচার্য রাজনৈতিক নেতা কিংবা কর্মীর মতো রাজনৈতিক চর্চায় সময় দেন বেশি। উপাচার্য যে একজন শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয় যে একটি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেটা অনেক সময় ভুলে যান। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসাবে স্বকীয়তা হারাচ্ছে। এজন্য উপাচার্যদের কর্মকাণ্ডের ওপর বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগের সময় হলে উপাচার্য পদের জন্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়। নিয়োগ পেতে উপাচার্য প্রার্থীরা তাদের ভালো চেহারাটাই উপস্থাপন করেন। যদিও উপাচার্য নিয়োগের জন্য কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না, তারপরও উপাচার্য প্রার্থীদের তদবির/লবিং দেখলে মনে হয় তাদের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় না বরং তারা নিজেরাই উপাচার্য হয়ে আসেন। তবে যেভাবেই নিয়োগ পান না কেন, একজন উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার সময় তাকে একটা লিখিত আন্ডারটেকিং দেওয়া দরকার, যেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বা নিয়মনীতির ওপর শ্রদ্ধাশীল থাকেন, কোনো ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা না করেন। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে যেন দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধান রাখা হয়। যেসব উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায়-অনিয়ম করবেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। এতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে বলেই মনে করি। তবে এটাও সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে অনেকে উপাচার্যবিরোধী কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। তাই এগুলোরও সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তবে বর্তমানে যেসব উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা করছেন, সরকারের উচিত সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তির আওতায় আনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করতে এর বিকল্প নেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়। স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয় মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র সুশাসন নিশ্চিত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সঠিক পরিবেশ বজায় রাখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান ধরে রাখতে না পারলে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ আরও কঠিন হবে।

লেখক: ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক; সাধারণ সম্পাদক, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধন: তৃতীয় দিনের ভাইভায় যেসব প্রশ্ন - dainik shiksha অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধন: তৃতীয় দিনের ভাইভায় যেসব প্রশ্ন এমপিও শিক্ষকদের বদলি আবেদন শুরু ১ নভেম্বর - dainik shiksha এমপিও শিক্ষকদের বদলি আবেদন শুরু ১ নভেম্বর পান থেকে চুন খসলেই ঘুষ নেন শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha পান থেকে চুন খসলেই ঘুষ নেন শিক্ষা কর্মকর্তা শিবিরের আত্মপ্রকাশের খবরে জাবিতে প্রতিবাদ মিছিল - dainik shiksha শিবিরের আত্মপ্রকাশের খবরে জাবিতে প্রতিবাদ মিছিল কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থীদের গালিগালাজ করায় সিটি কলেজ শিক্ষক বহিষ্কার - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের গালিগালাজ করায় সিটি কলেজ শিক্ষক বহিষ্কার please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026059150695801