দুর্নীতির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক বরখাস্ত

দৈনিক শিক্ষাডটকম, মানিকগঞ্জ |

দৈনিক শিক্ষাডটকম, মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জের শিবালয়ের উথলী আব্দুল গণি সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউছুব আলীর বিরুদ্ধে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠেছে। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়-ব্যয় নিরীক্ষা ও তদন্ত কমিটির কাছে তার আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ঘটনায় ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পরিচালনা কমিটি। 

শনিবার (৩০ মার্চ) প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের (এসএমসি) সভাপতি সালাহ উদ্দীন সরকার।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিভাবক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিবালয় উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন উথলী আব্দুল গণি সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। শুরু থেকেই এলাকায় বেশ সুনামের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে ২০১৬ সালে ইউছুব আলী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা শুরু। পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ না করে একক সিদ্ধান্তে কেনা-কাটাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন।

অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেমে এসেছে অর্থেকে। ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করে জোরপূর্বক টিআর সদস্যদের দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিতেন তিনি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলেই সহকারী শিক্ষকদের পাঠদানে বিরতরাখাসহ নানা হয়রানি করতেন ইউছুব আলী। সম্প্রতি প্রধান শিক্ষকের শাস্তি চেয়ে বিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষক-কর্মচারী ও ১২৮ জন অভিভাবক পরিচালনা কমিটি বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

ইসমাইল হোসেন নামে এক অভিভাবক জানান, আগে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ১২০০ থেকে ১৫০০ পর্যন্ত। অথচ এখন মাত্র ৬০০ শিক্ষার্থী। প্রধান শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সুবিধা অসুবিধার কোনো কথা শুনেন না। খারাপ আচরণ করেন। এ কারণে বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

সহকারী শিক্ষক পলাশ খান জানান, বিদ্যালয়ের আয় থাকলেও শিক্ষকদের স্কুল অংশের বেতন বন্ধ দীর্ঘদিন ধরে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা না দিয়ে তিনি টাকা অন্যখাতে খরচ করতেন। মূলত ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে তিনি সেই টাকা আত্মসাত করে আসছেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির আহবায়ক আব্দুর রশিদ বলেন, প্রধান শিক্ষক বিগত কমিটির কাছেও কোনো আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেননি। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর বিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আয়-ব্যয় হিসাব নিরক্ষণের উদ্যোগ নিই। অভ্যন্তরীণ নিরিক্ষা কমিটি ২০২৩ সালের স্কুলের আয়-ব্যয় হিসাবে ব্যাপক গড়মিল পায়। ব্যাংক লেনদেন, হিসাব খাতা এবং বিল ভাউচারের অমিল রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পরিচালনা কমিটির সভাপতির নির্দেশে অধিকতর তদন্তের জন্য আমাকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানেও অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিধিমালা অনুযায়ী একজন প্রধান শিক্ষক মাসে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করে বছরে এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন। কিন্তু ২০২৩ সালে প্রধান শিক্ষক ইউছুব আলী বিধি বহির্ভূতভাবে হাতে রেখে ১৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকা খরচ করেছেন।

এছাড়া তিনি গত বছর স্কুলের ব্যাংক হিসাব থেকে ৬১ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করলেও, ক্যাশ রেজিস্টার্ডে সেই টাকা উত্তোলন দেখানো হয়নি। পুরো টাকাই তিনি আত্মসাত করেছেন।

শিক্ষকদের হাজিরা নিশ্চিতের জন্য দুটি বায়োমেট্টিক মেশিন কেনা বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৬১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবে ওই মেশিন দুটির দাম মাত্র ১২ হাজার টাকা।

বিদ্যালয়ে ওয়াইফাই ইন্টারনেট বিল খরচ প্রধান শিক্ষক প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা দেখালেও, বিল পরিশোধ করা হতো মাত্র এক হাজার টাকা। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে বছরে ২৪ হাজার টাকা তিনি নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন। এভাবে তিনি আপ্যায়ন, রশিদ বই ও লিফলেট ছাপানো, খেলাধূলা, যাতায়াত, স্টেশনারী ক্রয়, মামলা খরচসহ নানা খাতে ভুয়া বিল ভাউচার দাখিল করে অন্তত্ব ২০ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন।

বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি সালাহ উদ্দিন সরকার জানান, অভ্যান্তরীণ আয়-ব্যয় নিরিক্ষায় তার ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারাও প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রমাণ পান। প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও তিনি কোনো জবাব দেননি। এমনকি সর্বশেষ সভায় তিনি উপস্থিত থাকলেও রেজুলেশন খাতায় স্বাক্ষর না করেই চলে যান।

গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ ও বিধিমালা মেনেই গত ২৭ মার্চ তাকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সেই সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সিনিয়র শিক্ষক হোসনে আরাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সাময়িক বরখাস্তকালীন সময় প্রধান শিক্ষক ইউছুব আলী মাসিক মূল বেতনের অর্ধেক খোরাকী ভাতা পাবেন এবং বিনা অনুমতিতে বিদ্যালয় চলাকালীন সময় কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না।

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে প্রধান শিক্ষক ইউছুব আলীকে একাধিকবার কল করলেও, তিনি রিসিভ করেননি।

শিবালয় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতা আবুল খায়ের জানান, প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্তের একটি অনুলিপি তিনি পেয়েছেন। এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের। তাই তার কিছু করার নেই। তবে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ - dainik shiksha শিক্ষককে পিটিয়ে হ*ত্যা, চাচাতো ভাইসহ গ্রেফতার ৩ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030958652496338