মানুষ শিক্ষা লাভ করে যেনো সে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। কিন্তু অনেকের প্রশ্ন শিক্ষা লাভ করলেই কি মানুষ একজন মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এ প্রশ্নের উত্তর জটিল। এক্ষেত্রে সক্রেটিসের একটি বক্তব্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে, ত্রুটিপূর্ণ এবং তোষামোদি শিক্ষা কাঠামো কখনো একটি জাতিকে সঠিক নির্দেশনা দেয় না। তোষামোদি শিক্ষাকাঠামো বলতে তিনি এক ধরনের গোলামি শিক্ষাব্যবস্থাকে বোঝাতে চেয়েছেন। বেশ কিছু জরিপে দেখা গেছে, দুর্নীতি যারা করেন তাদের সিংহভাগ উচ্চশিক্ষিত মানুষ। তাহলে শিক্ষা কি দুর্নীতি রুখে দিতে অক্ষম? না, বিষয়টি ঠিক এমন নয়। বরং শিক্ষা দুর্নীতি নির্মূলের এক মহাঔষধ হতে পারে। তবে সেই শিক্ষার ধরন ও প্রকৃতি আলাদা। ভোগবাদী আর পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে দুর্নীতি কখনো দমন সম্ভব নয় বরং সেটা আরো বাড়বে।
শিক্ষার সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে যুক্ত। একটি দেশের রাজনীতি পরিচ্ছন্ন হলে দুর্নীতি এমনিতেই অর্ধেক কমে আসে। যার মাঝে প্রকৃত দেশপ্রেমের শিক্ষা আছে সে কখনো অন্যায় বা দুর্নীতি করতে পারে না। দেশকে যে সত্যিকার অর্থে ভালবাসে সে বিন্দু পরিমাণ দুর্নীতি করতে পারে না। যারা দুর্নীতি করে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। দেশপ্রেমের শিক্ষায় ঘাটতি থাকলে অন্যায়, দুর্নীতির দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে। দেশপ্রেমের শিক্ষা মানুষ পেয়ে থাকে প্রথমত পরিবার থেকে। তারপর বিদ্যালয় থেকে। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষা কাঠামোতে দেশপ্রেমের শিক্ষাকে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণাও শিক্ষার্থীদর দেয়া উচিত। নতুন শিক্ষাক্রম যেনো শুধু পরীক্ষায় পাশের মাধ্যম না হয়। কোন শিক্ষাব্যবস্থা যদি কোনো শিক্ষার্থীকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলে ব্যর্থ হয় তবে সে শিক্ষাব্যবস্থাকে সার্থক বলা যায় না।
নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক কিছু যুক্ত করা হলো। কিন্তু আইনের মৌলিক শিক্ষা কেনো যুক্ত করা হলো না? ছোট থেকেই শিক্ষার্থীরা দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে অবগত থাকলে সেটা দেশ ও রাষ্ট্রের কাজে আসে। আইন শিক্ষাকে কেনো শুধু উচ্চতর পর্যায়ে রাখতে হবে? স্কুল পর্যায়ে কেনো আইন শিক্ষা যুক্ত করা হচ্ছে না? নাকি দেশের মানুষ আইন শিখলে সচেতন হয়ে যাবে যেটা কারো মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। বিশ্বের বেশ কিছু দেশে আইন শিক্ষাকে স্কুল পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এতো কারিকুলাম, এতো জ্ঞান, এতো প্রশিক্ষণ, এতো আয়োজন? কিন্তু এগুলো কি শুধু লোক দেখানো? আইন শিক্ষা ছোট থেকেই মানুষকে রাজনীতি সচেতন করে তোলে। তাদেরকে অধিকার সচেতন করে তোলে। তাদেরকে দেশপ্রেমিক হতে সহায়তা করে।
একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনগণ, সরকার এবং সার্বভৌমত্ব নিয়ে একটি দেশ বা রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্র ও নাগরিক একে অন্যের পরিপূরক। রাষ্ট্র যেমন তার নাগরিকের জন্য অধিকার ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে, তেমনি নাগরিককেও রাষ্ট্রের প্রতি কতোগুলো দায়িত্ব পালন করতে হয়। এই দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন করার মাধ্যমেই দেশ গঠনে একজন নাগরিক সত্যিকারের ভূমিকা রাখতে পারে। একটি দেশ গঠন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। রাতারাতি তা হয় না। জটিল এই প্রক্রিয়ায় নাগরিককে খুব সতর্কতার সঙ্গে ভূমিকা রাখতে হয়। দার্শনিক প্লেটো তার রিপাবলিক গ্রন্থে দেশ গঠনে নাগরিকের কী কী ভূমিকা থাকতে পারে তার একটি সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা দিয়েছেন। সক্রেটিস নাগরিকদের ‘Virtue of knowledge’ এর কথা বলেছেন। অ্যারিস্টটল, জন লক, হবস ও রুশো নাগরিকদের কর্তব্যগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। একজন নাগরিক নিচের দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করে দেশ গঠনে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন- দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ; দেশের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা; দেশের আইন ও সংবিধানের প্রতি আনুগত্য; ভোটের মাধ্যমে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন; সময়মত ও নিয়মমাফিক কর বা খাজনা প্রদান; নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান এবং প্রকৃত দেশপ্রেম।
একটি দেশের সকল নাগরিক একরকম হয় না। তারা বিভিন্নভাবে দেশ গঠনে সহায়তা করে। কেউ তার মেধা দিয়ে, কেউ প্রজ্ঞা দিয়ে, কেউ সাহস দিয়ে, কেউ দৈহিক শ্রম দিয়ে, কেউ পরামর্শ দিয়ে এবং কেউবা তার সৃষ্টি দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শেক্সপিয়ার, প্লেটো, অ্যারিস্টিটলসহ আরো অনেকেই যার যার অবস্থান থেকে দেশ গঠনে অবদান রেখেছেন। দেশ গঠনে একজন নাগরিক তার যোগ্যতা অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে পারে। এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো একজন নাগরিক দরদ দিয়ে যত্ন নিলে দেশ অনেক দূর যেতে পারে। এমন কিছু বিষয় হলো-দেশের বিদ্যুতের অপচয় না করা, রাস্তাঘাট ও পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে সতর্ক থাকা, পানির অপচয় না করা, পরিবেশ দুষণ না করা, বিভিন্ন স্থাপনাগুলিকে রক্ষা করা, দুর্নীতি না করা, শান্তি বজায় রাখা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং গুণী মানুষদের কদর করা।
এমন অনেক নজীর আছে এই বিশ্বে যেখানে একজন নাগরিক নিজ উদ্যোগে দেশকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন। এমন অনেক নাগরিক আছেন যারা নিজ উদ্যোগে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, মসজিদ, মন্দিরসহ নানা স্থাপনা তৈরি করে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখেন। একজন নাগরিক তার ক্ষুদ্র পরিসরে রাষ্ট্রের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। সক্রেটিস তরুণ সমাজকে আলোকিত করে রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। জে এস মিল তার উপোযোগবাদী দর্শনের ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘একটি সুখী শুকর হওয়ার চেয়ে একজন অসুখী মানুষ হওয়া ভালো এবং একজন সুখী মানুষ হওয়ার চেয়ে একজন অসুখী সক্রেটিস হওয়া আরো ভালো।’
বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর চেষ্টা ছিলো সীমাহীন। এ দেশের মানুষেরা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু এই স্বাধীনতার বিপক্ষেও কিছু মানুষ ছিলো যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়। দেশ গঠনের পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে সংযুক্ত হতে চলেছে। কিন্তু দুর্নীতি এই উন্নতির পথে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের একজন সুনাগরিক কখনোই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয় না। দেশের প্রতি যাদের প্রবল অনুরাগ আছে তারা কখনো দুর্নীতি করতে পারে না। দুর্নীতিবাজ প্রকৃতপক্ষে দেশের শত্রু। একজন নাগরিক তার বিবেকের কাছে সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধ থাকে। একটি দেশে শুধু কঠোর আইন প্রয়োগ করে সুনাগরিক তৈরি করা যায় না। সুনাগরিক তৈরির জন্য গড়ে তুলতে হয় নীতিনির্ভর একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি। দার্শনিক অ্যারিস্টিটল বলেছিলেন, ‘আমি নিজে থেকেই আইন মানি, আর অন্যরা মানে শাস্তির ভয়ে।’ অ্যারিস্টিটল এখানে একজন মাষের বিবেক সংস্কৃতির উপলব্ধিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। একটি দেশের নাগরিকদের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করা সবচেয়ে জরুরি। আর এই মূল্যবোধ তৈরির কারখানা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুনাগরিক তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। একজন সুনাগরিক তৈরি করতে হলে ওই ব্যক্তির মনোজগতে একটি বিরাট পরিবর্তন আনতে হয়। বিদ্যালয়গুলো শিশুদের মনোজগতকে সমৃদ্ধ করে দেয়। তাই সুনাগরিক তৈরির জন্য বিদ্যালয়গুলো তে নীতি শিক্ষা দেয়া হয়। তবে দুঃখের বিষয় এই যে শিক্ষার উদ্দেশ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ করে ফেলায় সুনাগরিক তৈরির পথ রুদ্ধ হচ্ছে। একটি দেশ অর্থনীতে সমৃদ্ধ হতে পারে, কিন্তু যদি সুনাগরিক তৈরিতে ব্যর্থ হয় তবে সে দেশকে কোনো একপর্যায়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে হবে। একটি দেশের সুনাগরিকরা দেহের রক্তনালীর মতো ভূমিকা রেখে থাকে। দেশের প্রয়োজনে তারা নিজেদের সব স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারে। কিন্তু একজন দুর্নীতিবাজের কাছে দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থ বড় হয়ে থাকে। যেকোনো মুহূর্তে নিজ প্রয়োজনে সে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। তাই সুষ্ঠু সমাজ বির্ণিমাণে সুনাগরিকের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সব সেক্টরে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সুনাগরিক তৈরিতে এখন বাংলাদেশ আশানুরূপ পর্যায়ে যায়নি। দেশের প্রতি ভালোবাসা শুধু মুখের বুলি নয়, অন্তরে ধারণ করতে হয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেকে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করার দরকার হয় না। নিজ কর্মই প্রমাণ করে কে কতোটা দেশপ্রেমিক। একজন সুনাগরিকের জীবন ধন্য হয়। মানুষ তাকে মনে রাখে যুগের পর যুগ। একজন সুনাগরিকের স্থান মানুষের মনে, মানুষের ঘৃণায় নয়।
পরিশেষে এটুকুই বলা যায়, একজন নাগরিকের নিজ দায়িত্বের প্রতি সচেতন হতে হবে। একজন নাগরিক নেতা নাও হতে পারে কিন্তু তার মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি থাকতে হবে। যেটুকু সামর্থ আছে সেটুকু কাজে লাগাতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দেশকে স্বাধীন করা প্রসঙ্গে জনগনকে বলেছিলেন, তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ো।’ কাজেই নিজ সক্ষমতাকে যথাযথ কাজে লাগালে দেশের উন্নয়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘দেশের জন্য দিলে রক্ত, বিবেকবোধ হইবে পোক্ত’।
লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।