বলার অপেক্ষা রাখে না যেকোনো প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন; আর প্রাণীটি যদি মানব প্রজাতির হয় তবে তার বেঁচে থাকার জন্য শুধু খাদ্য হলেই চলে না, তার সঙ্গে অতীব প্রয়োজন বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আবার এ মৌলিক চাহিদারগুলোর মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজন সর্বাগ্রে, যার ঘাটতি জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। এই মুহূর্তে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের গতি এতোটাই ঊর্ধ্বমুখী যে এই বল্গাহীন ও আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্যের প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে সীমিত আয়ের নাগরিকদের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা নিম্নবিত্তের একেবারে নাগালের বাইরে চলে গেছে। জনজীবনের গতিকে প্রায় অচল ও আড়ষ্ট করে তুলেছে। দ্রব্যের আশঙ্কাজনক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, দোকানপাটে সব জায়গায় এই বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে।
স্মর্তব্য, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলাভের মাত্র দুবছরের মাথায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি আমাদের জীবনে অতর্কিত হানা দেয়, মৃত্যুমুখে পতিত হয় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর একাংশ। সার্বিক পরিস্থিতি তদানিন্তন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তারপরের ইতিহাস অল্পবিস্তর সবারই জানা। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কারণ, মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। বর্তমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগামহীন ঘোড়া যেভাবে ক্ষিপ্রগতিতে ধাবমান, তা সেই ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রাকৃতিক কারণগুলো বর্তমানে প্রায় অনুপস্থিত, যা কিছু ঘটছে তা সম্পূর্ণই মনুষ্যসৃষ্ট। ব্যাপক বন্যা, শিলাবৃষ্টি, খরামারি বা অনাবৃষ্টি, অনুৎপাদন, পঙ্গপালের আক্রমণ কোনো কিছুই ঘটেনি, দেশে খাদ্যপণ্যের চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা নেই অথচ সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবেই দ্রব্যমূল্যের এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? হ্যাঁ, আসল কারণগুলো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, কালো টাকার দৌরাত্ম্য, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি, সংরক্ষণ ও বণ্টনে অব্যবস্থাপনা, সরকারি নজরদারির অভাব এবং অসৎ উদ্দেশে বিশেষ বিশেষ পণ্যের গুদামজাতকরণসহ আরো কিছু। কারণ, এই অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কাজ করে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের মানুষ আশা করেছিলো জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ পারদর্শিতায় ও তত্ত্বাবধানে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসবে, সীমিত আয়ের মানুষেরা সস্তায় খাদ্যপণ্য কিনে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনে সক্ষম হবে। কিন্তু ঠিক তার বিপরীত চিত্র দর্শনে মানুষ এখন হতাশার সমুদ্রে নিমজ্জিত।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধি শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত করে। নিম্নবিত্ত ও হতদরিদ্র পরিবার তিন বেলা খাবার সংগ্রহেই হিমশিম খায়। কাজেই তাদের সন্তানরা অকালেই ঝরে পড়ে শিক্ষা থেকে। যে বাবা তার সন্তানদের মুখে তিন বেলা খাবার তুলে দিতেই অক্ষম, তিনি কীভাবে সন্তানদের শিক্ষা-উপকরণের যোগান দেবেন ও লেখাপড়ার খরচ বহন করবেন? আমরা করনাকালীন দুই বছরে দেখেছি বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বেশকিছু স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হঠাৎ করেই কমে গিয়েছিলো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সন্তানদের লালনপালনে অক্ষম হয়ে তাদের পিতামাতা অকালেই, অপরিণত বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলে সন্তানরা স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পেটের দায়ে বিভিন্ন কলকারখানায় শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি কি তবে ধীরে ধীরে সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে?
একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদগুলোর মধ্যে মানবসম্পদ বিশেষ করে দক্ষ জনগোষ্ঠী অন্যতম ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তরান্বিতকরণ, টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদির জন্য দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না-মানুষের জন্যই উন্নয়ন এবং মানুষই উন্নয়নের অপরিহার্য নিয়ামক। আমরা পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই দেখতে পাই তারা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর কিন্তু প্রয়োজনীয় জনসংখ্যা অর্থাৎ মানবসম্পদ না থাকায় পূর্বের অনুন্নত দেশগুলো থেকে হরহামেশাই জনশক্তি আমদানি করে তাদের কলকারখানা চালু রাখে এবং উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করে। অথচ আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে আমরা এ যাবতকাল জনসমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আসছি। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্স জনসংখ্যাকে মানবীয় মূলধন বা হিউম্যান ক্যাপিটাল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই মানবীয় মূলধনকেই আমরা আধুনিক পরিভাষায় মানবসম্পদ নামে অভিহিত করছি। জনগণকে তখনই জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা যায় যখন তাকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা ও পরিচালনা করা যায়। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমেই একজন মানুষ সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা হয়ে নিজেকে অন্যান্য সম্পদের মতোই একটি সম্পদে পরিণত করে। মানবসম্পদ উন্নয়ন হলো জনসম্পদের এমন এক গুণগত পরিবর্তন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা উৎপাদনক্ষম ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে এবং মানবীয় শক্তি-সামর্থ্যের সর্বোত্তম বিকাশ সাধনে সক্ষম হয়। একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে সেই দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের ওপর।
মানবসম্পদ উন্নয়ন আপনা-আপনি হয় না, এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিজ্ঞান। উপযুক্ত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য মানবসম্পদ উন্নয়নের চাবিকাঠি। আর এ উন্নয়নের পেছনে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা থাকা খুবই জরুরি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা, শিক্ষায় যথাযথ বাজেট বরাদ্দ, শিক্ষার মান বৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার মানবসম্পদ উন্নয়নের গতিকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারেন। উপযুক্ত শিক্ষা মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে, আত্মসচেতনতা তৈরি করে এবং তাদের পুরনো অভ্যাস ও রীতিনীতি বদলে দিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখায় এবং নব-ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত করে। একজন যথার্থ শিক্ষিত ব্যক্তি স্ব-উদ্যোগে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, রেডিও-টেলিভিশন এবং সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে পারেন, সৃজনশীলতা অর্জন করেন, সমাজ সচেতনতা লাভ করেন এবং নিজের মধ্যে নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ববোধের উন্মেষ ঘটিয়ে উন্নত সমাজ গঠনে বিশেষ অবদান রাখতে পারেন। প্রতিটি সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রেই আত্মসচেতন, স্বাস্থ্য সচেতন এবং অন্যের জন্য সুন্দর জীবনের প্রেরণা স্বরূপ। বিগত কয়েক দশকে আমরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের শিক্ষার্থী এবং প্রযুক্তিবিদরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। এতদ সত্ত্বেও অতিসাম্প্রতিক আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়ন একটা বিরাট ধাক্কার সম্মুখীন হতে চলেছে দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতির কারণে। যার মগজ পাকস্থলী পূরণের চিন্তায় সার্বক্ষণিক ব্যতিব্যস্ত, তার সৃজনীশক্তি, উদ্ভাবনী শক্তির উন্নয়নে চিন্তা করার সুযোগ কোথায়?
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা সাধারণ মানুষের জীবনকে দিনদিন দুর্বিষহ করে তুলছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোক ব্যতীত বেশিরভাগ মানুষই নিজের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগানে অক্ষম। বাধ্যতামূলক ব্যয় সংকোচন জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে নেমে যাচ্ছে জীবনযাপনের মান, নিচে নেমে যাচ্ছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মানও। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়ছে আমাদের শিশুদের ওপর। শিশুরা উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে, যত্নের অভাবে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না, যার নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। শুধু কি তাই? স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য বাড়তি আয়ের প্রয়োজনে অনেকে অবৈধ উপার্জনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে অহরহ। মানুষ অনৈতিক জীবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সমাজে নেমে আসছে নানা অবক্ষয়।
এহেন পরিস্থিতি থেকে আশু মুক্তির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ নীতিমালা প্রণয়ন, বাজার তদারকি, অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ধ্বংসকরণ, চোরা-কারবারি ও কালোবাজারিদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষিতে ভর্তুকি বৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি নানামুখি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার বাহাদুর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে পারেন এবং স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে জনজীবনে। বর্তমানে বিরাজমান অবস্থা বেশিদিন চলতে দিলে সবকিছু সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং দেশ ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষের মতো করুণ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাবে। জনগণ এখনো আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে সরকার অতি দ্রুত আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলার জনগণ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে ও দেশ হবে সমৃদ্ধ।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়