দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: বাজারে নানা নামের দেশি-বিদেশি প্রসাধনীর ছড়াছড়ি। এই ভিড়ে ভেজাল বা নকল এবং মানহীন প্রসাধনীরও অভাব নেই। পাড়ার ছোট দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় বিপণিবিতান—সবখানেই মিলেমিশে আছে আসল-নকল। নকল পণ্যে ক্রেতার আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ত্বকেরও ক্ষতি হচ্ছে।
ত্বক বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা বলছেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহার ত্বকের জন্য বিপজ্জনক। ত্বকে ঘাসহ নানা জটিল রোগ হতে পারে। ত্বকের ক্যানসারও হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রসাধনীর বিশাল বাজার এবং বিদেশি পণ্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণকে পুঁজি করে অতি মুনাফার আশায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জেনেশুনে মানুষকে এই বিপদে ফেলছেন। নকল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে কঠোর আইন ও তৎপরতা না থাকার সুযোগ নিচ্ছেন তাঁরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও নকল প্রসাধনী তৈরি থামছে না।
সূত্র বলেছে, দেশে প্রসাধনসামগ্রীর বাজার কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকার। বাজারে থাকা প্রসাধনপণ্যের ৪০-৪৫ শতাংশই ভেজাল ও মানহীন। এর মধ্যে চীন, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানহীন পণ্যও আছে। আবার মোড়কে বিদেশি হলেও তৈরি হচ্ছে দেশেই। দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির কাটতি থাকা প্রসাধনপণ্যও নকল হচ্ছে। মোড়ক দেখে আসল-নকল বোঝাও মুশকিল।
নকল প্রসাধনী সবচেয়ে বেশি তৈরি হয় পুরান ঢাকার লালবাগ, চকবাজার, বেগমবাজার, মৌলভীবাজার, মোগলটুলী, ইসলামবাগ, ছোট কাটরা, বড় কাটরা এবং বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারের কেরানীগঞ্জ। সাভার, আশুলিয়া এমনকি উত্তরাঞ্চলেও নকল প্রসাধনী তৈরি হচ্ছে। নকল প্রসাধনীর বড় পাইকারি বাজার চকবাজার, বেগমবাজার ও মৌলভীবাজার। এ তিন স্থান থেকেই মূলত রাজধানীসহ সারা দেশে নকল ও ভেজাল প্রসাধনী ছড়িয়ে পড়ছে। শ্যাম্পু, লোশন, ত্বক ফরসাকারী ক্রিম, টুথপেস্ট, জেল, বডি স্প্রে, কন্ডিশনার, ক্রিম, লিপস্টিক, নেইল পলিশ, দাগ-মেছতা দূর করার ক্রিম, স্নো, পারফিউম, পাউডার, সানস্ক্রিন বেশি নকল হচ্ছে। বিদেশি পণ্যের প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকায় নকল করার প্রবণতাও বেশি।
পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) বলছে, আমদানি করা প্রসাধনী বন্দরে আসার পর নমুনা বিএসটিআইয়ে পরীক্ষা করে মানসম্মত হলে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এসব প্রসাধনীর মোড়কের গায়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের দাম, পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য এবং বিএসটিআইয়ের মানচিহ্নসহ বাংলায় লেখা একটি স্টিকার থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বারকোডও থাকে। কোনো পণ্যে ওই স্টিকার না থাকলে তার অর্থ সেটি অবৈধভাবে আনা হয়েছে। মানও যাচাই হয়নি।
ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানির পাশাপাশি লাগেজ পার্টির মাধ্যমেও কিছু প্রসাধনী বিদেশ থেকে আসে। সেগুলোর গায়েও বিএসটিআইয়ের নির্দেশিত তথ্যসংবলিত স্টিকার থাকে না। কখনো কখনো স্টিকারও নকল করে ভেজাল পণ্যের মোড়কে সেঁটে দেওয়া হয়। বারকোডও থাকে। এতে তাঁরাও ধোঁকা খান।
রাজধানীর পরীবাগের এক গৃহবধূ মোড়কের গায়ে পাকিস্তানে তৈরি লেখা থাকা ত্বক ফরসা করা ক্রিম ব্যবহার করে ত্বকের সমস্যায় পড়েন। তাঁকে চিকিৎসকের শরণাপন্নও হতে হয়। তাঁর স্বামী একটি বহুজাতিক প্রসাধনী কোম্পানির চাকরিজীবী হলেও ভেজাল ধরতে পারেননি। এমন ঘটনার শিকার অনেকেই হচ্ছেন।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের চিফ কনসালট্যান্ট ড. দীপক কুমার দাস বলেন, নকল ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারে অ্যালার্জিজনিত জটিলতা দেখা দেয়। এ ছাড়া ত্বকে দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ হতে পারে। এ ধরনের প্রসাধনী দীর্ঘদিন ব্যবহারে ক্যানসারও হতে পারে। তিনি এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের পরামর্শ দিয়ে বলেন, এদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
চকবাজারের প্রসাধনী ব্যবসায়ীরা বলেন, আমদানি করা কসমেটিকসের মোড়কে বাংলায় স্টিকার দেখে অনেক ক্রেতাই দেশে তৈরি মনে করে কিনতে চান না। এ কারণে কোনো কোনো বিক্রেতা ওই স্টিকার তুলে ইংরেজিতে বেশি দাম লেখা স্টিকার সেঁটে দেন। দামে ছাড় দেওয়ায় ক্রেতাও বিদেশি মনে করে খুশি হয়ে কেনেন। এসব আসল পণ্যের ভিড়ে নকল পণ্যও থাকে। হুবহু মোড়ক থাকায় ক্রেতা বুঝতে পারেন না। এ ছাড়া আসল-নকল পণ্যের দামেও ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আসল পণ্যে দামে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আসলের হুবহু দেখতে নকল পণ্য পাওয়া যায় অর্ধেক দামে।
বনশ্রীর একটি দোকানে বিশ্বখ্যাত ওলে ব্যান্ডের প্রসাধনী থাকলেও কোনোটির গায়ে বাংলায় লেখা স্টিকার ও বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন নেই। একই চিত্র দেখা গেল বেগমবাজারে প্রসাধনীর একটি পাইকারি দোকানে। কোনো প্রসাধনীর গায়েই বাংলায় স্টিকার নেই।
বেগমবাজারের প্রসাধনী ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, নামীদামি প্রতিষ্ঠানের প্রসাধনী নকল হচ্ছে। আবার একটি প্রতিষ্ঠান একটি চালানের অনুমোদন নিয়ে কয়েকটি চালান আনছে অনুমোদন ছাড়া। বিভিন্ন সংস্থাকে ‘ম্যানেজ’ করে ব্যবসা চালাচ্ছেন।
সূত্র বলেছে, দেশে প্রসাধনীর বাজারের ৬০ শতাংশ দেশীয় ও ৪০ শতাংশ বিদেশি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির আগে বাজারে আমদানি করা প্রসাধনী ছিল ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি জহিরুল হক ভুইয়া বলেন, আসল-নকল কসমেটিকস চেনা বড় মুশকিল। অনেকে চীন থেকে আমদানি করে। বিএসটিআই ও জেলা প্রশাসনের অভিযানের কারণে ভেজালের পরিমাণ এখন কমে আসছে। আসল চিনতে হলে মোড়কের বারকোড স্ক্যান করলে উৎপাদনকারীর নাম-ঠিকানা পাওয়া যাবে।
নকল ও ভেজাল প্রসাধনের বিরুদ্ধে বিএসটিআই ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মাঝে অভিযানও চালায়। বিএসটিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভেজাল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ১৪টি অভিযান চালানো হয়। এসব অভিযানে জরিমানা করা হয় ১৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা। ভেজাল প্রসাধনী উৎপাদন ও বোতলজাত করায় একজনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এসব অভিযানে প্রায় ৫৩ লাখ টাকা মূল্যের ভেজাল প্রসাধনী ধ্বংস করা হয়। তবে এসব অভিযানেও নকল প্রসাধনী তৈরি ও বাজারজাত করা বন্ধ হয়নি।
বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক বলেন, আমদানি করা প্রসাধনীর গুণগত মান পরীক্ষার পরই ছাড়পত্র দেওয়া হয়। নকল-ভেজাল প্রসাধনী উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে।