নতি স্বীকারের সুযোগ নেই

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একাত্তরের স্বাধীনতার পরে দেশপ্রেম অবশ্যই জেগে উঠেছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে একটি এলাকার কথাই ধরা যাক। সেখানে রাজাকার ছিল না। তরুণদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই দেখা গেল আসল-নকল মিলে যোদ্ধার সংখ্যা অনেক। নকল ও আধা নকলেরা জবরদখল শুরু করল। অন্যদের কয়েকজন উদ্যোগ নিল পাঠাগার পুনর্গঠনে এবং একটি কলেজ স্থাপনে। এলাকায় কোনো কলেজ ছিল না। পড়াশোনায় তাই অনেক বিঘ্ন ছিল, বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। স্বাধীনতার পরে বিদ্যোৎসাহ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রবল হওয়ায় একটি নয়, দুটি কলেজই দাঁড়িয়ে গেল। একটি কলেজের কথা আমরা বিশেষভাবে জানি। সেই কলেজ প্রতিষ্ঠার পরে ছাত্র ও শিক্ষকদের খেয়াল হলো যে কলেজে একটি শহীদ মিনার চাই। প্রিন্সিপাল নবীন যুবক, ছাত্রজীবনে সদস্য ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের; তাঁর উৎসাহে ছেলে-মেয়েরা উদ্দীপ্ত হলো একটি শহীদ মিনার নির্মাণে। সাবেক মুসলিম লীগের দুই-একজন মৃদু আপত্তি তুলেছিল। তাঁদের বক্তব্য শহীদদের উদ্দেশে মিলাদ পড়লেই তো চলে, মিনার আবার কেন। কিন্তু উৎসাহ তাতে বাধা মানেনি; বরং প্রবল হয়েছে। প্রধান অন্তরায় দাঁড়াল ইট পাওয়া নিয়ে। তিন কিলোমিটার দূরে একটি ইটখোলা ছিল; তার মালিককে রাজি করানো গেল বিনা মূল্যে ইট সরবরাহে। ইট তো পাওয়া গেল; কিন্তু আনা যাবে কিভাবে? রাস্তা বলতে গেলে ছিলই না, যানবাহন পাওয়ার প্রশ্ন উঠে না। কিন্তু উৎসাহ তো বাঁধ মানবে না। ঠিক হলো ছেলে-মেয়েরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যাবে, কলেজ থেকে ইটখোলা পর্যন্ত তিন কিলোমিটারজুড়ে তৈরি হবে এক মানববন্ধন। হাতে হাতে ইট উঠে আসবে। উৎসাহ  দেখে এলাকার লোকেরাও যোগ দিল সেই স্থির মিছিলে। হাতে হাতে ইট ঠিকই চলে এসেছে। শহীদ মিনার তৈরি হয়েছে। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত দুই-চারজন ছিলেন। তাঁদের প্রভাবে ছাত্র ইউনিয়নের একটি শাখা আগে থেকেই ছিল। স্বাধীনতার পরে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে; তারা কর্মশালা করেছে, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলার আয়োজন এসবে মন দিয়েছে এবং হাত লাগিয়েছে স্থানীয় লোকদের উপকারে। রাস্তাঘাট ঠিক করা, বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, মজা পুকুর উদ্ধার করা, গাছ লাগানো, ছাত্ররা এসব কাজ করেছে। এমনটি লোকে আগে কখনো দেখেনি, এই প্রথম দেখল। মনে হয়েছিল নতুন দিন এসে গেছে। কিন্তু তার পরে? এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির নামকরা যে ব্যক্তি ছিলেন, দেখা গেল তিনি যোগ দিয়েছেন বাকশালে, কলেজের প্রিন্সিপাল চলে গেছেন সরকারি চাকরিতে, পরে শোনা গেছে সমাজতন্ত্রে তিনি আস্থা হারাননি ঠিকই, তবে হজ করে এসেছেন, নিজের পয়সায়। ওই দুইয়ের ভেতর তিনি কোনো বিরোধ দেখতে পাননি।

ওই এলাকায় এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। বিদ্যুৎ এসেছে, শহরের সঙ্গে বাস সার্ভিস রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যোগ দিয়ে কেউ কেউ খুব ভালো ফল পেয়েছেন। বিদেশে গেছে বহু মানুষ। তাদের পাঠানো টাকায় ঘরবাড়ি সুন্দর হয়েছে। কিন্তু সেই উৎসাহ, সেই উদ্দীপনা আর নেই। হাতে হাত ধরে ছেলে-মেয়েরা আর দাঁড়ায় না। সাংস্কৃতিক জীবনের চাঞ্চল্য যা ছিল এখন প্রায় নিঃশেষ। আগে যেখানে নাটক হতো, এখন সেখানে ওয়াজ হয়। ঘরে বসে সবাই চ্যানেল দেখে, মোবাইল নিয়ে এপথে-ওপথে ঘোরে। মোটরসাইকেল এসেছে। মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যায়। শিক্ষার ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহ ছেলেদের চেয়ে বেশি। ছেলেরা বিদেশে যায়, তাদের ভাই-ভাতিজা, ভাগ্নেরা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে মোটরসাইকেলে চড়ে কালো চশমা চোখে লাগিয়ে ঘোরাফেরা করে। তাদের একটাই নির্দিষ্ট কাজ, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। পিছু লাগা সইতে না পেরে একটি তেজস্বী মেয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাই করেছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে এলাকার একজন লোক আত্মহত্যা করেছিল; গত বছর একজন নয়, তিনজন আত্মহত্যা করেছে, একই পরিবারের; স্বামী, স্ত্রী ও কন্যা। তারা ঋণের ভার সইতে পারেনি। ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছিল, একাধিক এনজিও থেকে। উন্নতি যে হয়েছে তাতে সন্দেহ কোথায়?

পুঁজিবাদীরা জ্ঞানের যথার্থ চর্চাকে উৎসাহ দেয় না, কারণ প্রথমত পণ্য হিসেবে জ্ঞানের ভালো বাজার নেই, দ্বিতীয়ত তারা জানে জ্ঞান মানুষের চোখ খুলে দেয়, চোখ খুলে গেলে আশঙ্কা থাকে বিপ্লবী হয়ে যাওয়ার। কোনো যুগেই কিন্তু জ্ঞান ছাড়া বিপ্লব ঘটেনি, পুঁজিবাদের বর্তমান স্তরে তো জ্ঞান না থাকলে চলবেই না; কিন্তু বিপ্লবী জ্ঞান শুধু অর্জনের ব্যাপার নয়, ব্যাপার প্রয়োগেরও এবং বিপ্লবী জ্ঞান সর্বদাই প্রশ্ন করে, প্রশ্ন করতে করতে এগোয়। আমাদের দেশে বিপ্লব না ঘটার পেছনে জ্ঞানানুশীলনের ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা যে একটি বড় কারণ তাতে সন্দেহ কী।

পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধটা চলছে, তাতে পুঁজিবাদ জিতবে না, মানুষই জিতবে। কবে জিতবে, কিভাবে জিতবে—সেটা অনেকটাই নির্ভর করছে মানুষের বিপ্লবী তৎপরতার ওপর। সব মানুষের ভেতরেই বিপ্লবী সম্ভাবনা থাকে, তাকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব যারা অগ্রসর চিন্তার হৃদয়বান মানুষ তাঁদের। বিপ্লবী চেতনাকে জাগিয়ে তোলার কাজে মিডিয়াকে ভুললে চলবে না। মার্কস-এঙ্গেলস ও লেনিনের যুগে শুধু ছাপাখানার ওপরই নির্ভর করতে হতো। একালে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এসেছে। এই মিডিয়া মানুষের সঙ্গে নানাভাবে শত্রুতা করে চলেছে। বিপ্লবের জন্য একেও ব্যবহার করা চাই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমন আত্মসন্তোষের কোনো অবকাশ নেই যে স্ট্যাস্টাস দিলেই বৈপ্লবিক কর্তব্য পালন করা হয়ে গেল। ফেসবুকের কথোপকথন ছায়ার সঙ্গে যোগাযোগই থাকে, যদি না সে ডাক দেয় মানবিকভাবে মিলিত হওয়ার। সেই মানবিক মিলন সামাজিকভাবেই ঘটবে, সমাজের নানা প্রাঙ্গণে। দেশে ও সারা বিশ্বে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে জ্ঞানের ও নৈতিকতার ওই দুই গুণের নিরিখে আমাদের দেশের সমাজবিপ্লবীদের অবস্থান যে অত্যন্ত উঁচুতে তা মোটেই নয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অর্জন দৃশ্যমানরূপেই বুর্জোয়াদের অর্জনের তুলনায় নিচুতে। তবে এটা অবশ্যই বলা যাবে যে নৈতিকতার ক্ষেত্রে মানটি বেশ উঁচুতে। বুর্জোয়াদের নৈতিক সংকীর্ণতা তাদের নেই। কিন্তু বিপ্লবীদের সবাই যে সুবিধাবাদিতার ঊর্ধ্বে ছিলেন এমন নয়। যৌবনে বিপ্লবের আওয়াজ দিয়েছেন; কিন্তু বয়স বাড়লে জাতীয়তাবাদী ধারায় বিলীন হয়ে গিয়ে সুবিধা হাতড়েছেন, সমাজবিপ্লবী নেতাদের ভেতর এমন দৃষ্টান্ত মোটেই বিরল নয়। পুঁজিবাদ তাদের কোলে টেনে নিয়েছে।

জিতবে মানুষই। পুঁজিবাদের পতন অবশ্যম্ভাবী, কর্তব্যটা হচ্ছে সেই পতনকে ত্বরান্বিত করা। এ ক্ষেত্রে রণনীতি স্থির করা আছে, রণকৌশলের ক্ষেত্রেই চাই উদ্ভাবন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেই রয়েছে আশা, ভরসা এবং সুখ; সেই সুখ, যার কথা মার্কস লিখে গেছেন তাঁর মেয়ের হাতখাতাতে। এই সংগ্রামে বিপ্লবীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। আমরা আওয়াজ শুনি বামপন্থীদের ঐক্য চাই। সত্যিকারের প্রয়োজনটা কিন্তু বামপন্থীদের ঐক্য নয়, বিপ্লবীদের ঐক্য। কারণ বামপন্থী মাত্রেই যে বিপ্লবী এটা মোটেই সত্য নয়। বামপন্থীরা বিভিন্ন কিসিমের হয়ে থাকে, তারা তো এমনকি লেজুড়ও হয় বুর্জোয়াদের এবং দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দেশের বামপন্থীদের অনেকেই আজকাল ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি তুলতেও ভয় পায়। অথচ কে না জানে যে এমনকি বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে একেবারে প্রথম শর্ত। বামপন্থীদের নয়, আসলে ঐক্য প্রয়োজন সমাজবিপ্লবীদের, যাদের প্রধান পরিচয় এটা যে তারা পুঁজিবাদের পতন চায় এবং সেই লক্ষ্যে সংগ্রাম করে। বামপন্থীরা ডানে ও বামে ঝুঁকতে পারে, ঝোঁকেও; কেউ হয় হঠকারী, কেউ সাজে উদারনৈতিক; বিপ্লবীদের জন্য কিন্তু সব রকমের বিচ্যুতিই নিষিদ্ধ। তাদের লক্ষ্য সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত। বিপ্লবী আন্দোলনে প্রাণবন্ততা অত্যাবশ্যক; কিন্তু সেটি থাকবে সুশৃঙ্খল, দুই পারের ভেতর নদীর স্বতঃস্ফূর্ত প্রবহমানতার মতো। এই যুদ্ধে আর যা-ই থাকুক নতি স্বীকারের কোনো জায়গা নেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027849674224854