গত ২৬ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) নিজেদের ওয়েবসাইটে এক দিনে দুটি সতর্ক বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। কারণ হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তির নামে প্রতারকচক্র বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। হাজার হাজার শিক্ষক ঋণ ও ধারকর্জ করে প্রতারকদের টাকা-পয়সা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। এই প্রতারকরা এতটাই কৌশলী যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে অফিশিয়াল প্যাডে এবং মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল স্মারক নম্বর ব্যবহার করে একের পর এক জাল চিঠি ও আদেশ-নির্দেশ পাঠাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ভুয়া নির্দেশ যাচ্ছে মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছেও। ভুয়া স্মারক নম্বর ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে এসব নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে।
আবার ক্ষেত্রবিশেষে অস্তিত্বহীন কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করেও চিঠি পাঠানো হচ্ছে। চিঠি পাঠানো হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তর ও প্রকল্পের নামেও। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র মন্ত্রণালয়ের নামে নানা ভুয়া চিঠিপত্র ছড়িয়ে অর্থ আদায়ের ফন্দি এঁটেছে। বেশ কিছুদিন ধরে এ কাজ চললেও এখন পর্যন্ত প্রতারকচক্রের কেউই চিহ্নিত হয়নি। মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপও এ বিষয়ে যথেষ্ট নয় মন্তব্য অনেকের। শুধু সতর্ক বিজ্ঞপ্তি দিয়েই মন্ত্রণালয় দায়িত্ব সেরেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও মাউশিরই কিছু লোক জড়িত। আর এতে সহজেই বোঝা যায়, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের স্মারক নম্বর ব্যবহার করা, বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নাম ও পদবি ব্যবহার করা এসব প্রতিষ্ঠানের লোকজন ছাড়া কিভাবে সম্ভব? সম্ভবত এ কারণেই তারা এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গত ১২ আগস্ট ২৭১টি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের গেজেট হয়। আরো ৪০টি কলেজের গেজেটভুক্তি মামলাসহ নানা কারণে আটকে আছে। নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার নামে মন্ত্রণালয়, মাউশি ও মাঠপর্যায়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং দালালের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটই জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তকরণের নামে সারা দেশ থেকে নানা কৌশলে টাকা-পয়সা আদায় করছে। নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন নেওয়া হয়েছে গত ৫ থেকে ১৮ আগস্ট। এগুলো এখন সরকারের বিবেচনাধীন। সারা দেশের সাড়ে সাত হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় সোয়া লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এ মুহূর্তে এমপিওভুক্তির আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ঠিক সে সময়ই হাজার হাজার বেসরকারি স্কুল-কলেজে ভুয়া চিঠি পাঠিয়ে তাদের অনলাইনে তালিকাভুক্ত হতে এবং ইউজার আইডির পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে বলা হয়। এ জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নম্বরও দেওয়া হয় এবং শিক্ষকপ্রতি দুই হাজার টাকা করে পাঠাতে বলা হয়। জানা যায় যে এ বিষয়গুলোকে পুঁজি করে প্রতারণা শুরু হয়েছে মূলত ১৫ জুলাই থেকে।
প্রতারণা হচ্ছে বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন কৌশলে। যেমন—বেতন বাড়ানোর প্রতারণা, বিভিন্ন তথ্য চেয়ে প্রতারণা, স্টুডেন্ট সাপোর্ট নামে প্রতারণা ইত্যাদি। গত ১ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নামে আরো একটি ভুয়া চিঠি সারা দেশের সব জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নিজ প্রতিষ্ঠানের প্যাডে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ছক অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান প্রধানের নাম, তথ্য আদান-প্রদানের ই-মেইল এবং প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মোবাইল নম্বর ই-মেইলযোগে পাঠাতে বলা হয়। মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় এ ধরনের কোনো চিঠি তারা ইস্যু করেনি যদিও কথিত ওই চিঠিতে স্বাক্ষরদাতা বাজেট শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব জাহাঙ্গীর আলম। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে ওই নামে বাজেট শাখায় কোনো সিনিয়র সহকারী সচিব নেই। অতএব বিষয়টি ভুয়া। কিন্তু কিভাবে প্রতারকরা এত বড় ধরনের জালিয়াতির সুযোগ পায়? আর অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে এত হালকাভাবে নিচ্ছে কেন?
অন্য আরেকটি প্রতারকচক্র ‘স্টুডেন্ট সাপোর্ট প্রগ্রাম ফর সেকেন্ডারি এডুকেশন’-এর নামে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে অভিনব প্রতারণা শুরু করেছে। তারা শিক্ষার্থীদের আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচির কথা বলে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছে। ওই চিঠিতে কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। শিক্ষার্থীরা যোগাযোগ করলে তাদের জানানো হয়, তারা ঘরে বসে মাসিক ৪০০ টাকা করে অর্থ সহায়তা পাবে। এ জন্য তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ৫০ টাকা ‘বিকাশ’ করে পাঠাতে হবে। রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুলসহ সারা দেশের প্রায় তিন হাজার স্কুলে এমন চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রতারকচক্র কত কৌশলী ও শক্তিশালী হলে তারা রাজধানীর নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এ ধরনের চিঠি দিতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। চিঠিতে সই করেছেন তথাকথিত ‘স্টুডেন্ট সাপোর্ট প্রগ্রাম ফর সেকেন্ডারি এডুকেশন’-এর পরিচালক প্রফেসর এন এম এস উদ্দিন। তাঁর স্বাক্ষরে সরকারি চিঠির মতো করে সরকারি মনোগ্রাম ব্যবহার করে এ ভুয়া চিঠি পাঠানো হয়েছে। ভুয়া এ চিঠিতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্যও ৩০ হাজার করে টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়েছে। প্রতারকচক্র তাদের অফিসের ঠিকানা হিসেবে ৩/খ/৪-পরীবাগ, নকশী স্টোর, ঢাকা উল্লেখ করেছে। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ রয়েছে, পুলিশ বিভাগ রয়েছে, শিক্ষা মনিটরিং ইউনিট রয়েছে, অথচ মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর থেকে সরকারি নিয়মানুযায়ী চিঠিপত্র ও নির্দেশ যাচ্ছে আর আমরা শুধু বলব যে এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কোনো যোগাযোগ নেই। বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের অওতায় নিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘মন্ত্রণালয়ের কোনো আদেশ-নির্দেশ পেয়ে সন্দেহ হলে শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা যেন তা অবশ্যই যাচাই করে নেন। মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি আদেশ-নির্দেশ নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সেখান থেকেও সবাই যাচাই করে নিতে পারেন। চিঠিপত্র, এসএমএস বা অন্য কোনোভাবে কেউ টাকা-পয়সা চাইলে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পুলিশকে তা জানিয়ে দিন। আমাদেরও জানান।’ যথার্থই বলেছেন তিনি। তার পরও আমরা আশা করব এর চেয়ে কঠিন কোনো ব্যবস্থা মন্ত্রণালয় নেবে, যাতে এটি ব্যাধির মতো ছড়িয়ে না পড়ে। জানা গেছে, বেসরকারি স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ ও নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কথা বলে প্রতারকচক্র মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এর আগে গত বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য তালিকাভুক্তির কথা বলে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। সেবারও মন্ত্রণালয় শুধু গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায় এড়িয়েছিল। মন্ত্রণালয় থেকে এক সতর্কবার্তায় বলা হয়, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির লক্ষ্যে একটি প্রতারকচক্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্টের ভুয়া স্বাক্ষরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পত্র প্রেরণ করেছে। পত্রে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডে (মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট) টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে, এর সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। মন্ত্রণালয় এর সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়েরই কেউ না কেউ হয়তো জড়িত, তা না হলে এ ধরনের চিঠি ও স্মারক বাইরের কারোর ব্যবহার করার কথা নয়।
একইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নামে একটি ভুয়া চিঠি সারা দেশে জাতীয়করণ হতে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পাঠানো হয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তির নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার নজির আমাদের দেশে কম নেই। সরকারি কোনো চাকরি, অর্থ বরাদ্দ বা কোনো স্বীকৃতি অনুমোদনের আশ্বাস দিয়ে প্রার্থীর কাছ থেকে আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা আদায় করার খবর বিভিন্ন সময়েই আমরা সংবাদমাধ্যমে জেনেছি। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর পদক্ষেপের কথা আমরা কখনো শুনিনি, আর তাই এ বিষয়টি বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মন্ত্রণালয় শুধু বিজ্ঞপ্তি দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেছে, যা কোনোক্রমেই ঠিক নয়। এটি কোনো সাধারণ বিষয় নয়। যেখানে একজন সম্মানিত শিক্ষককে সামান্য হেরফেরের কারণে সাজা ভোগ করতে হয়, সেখানে এত বড় অপরাধ করার পরেও কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? একসময় ছিল যখন বেসরকারি শিক্ষকরা নিয়োগ পেতেন প্রকৃত পরীক্ষার মাধ্যমে। বর্তমানে যা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে (ব্যতিক্রম ছাড়া) শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ পান এককালীন বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে। এই অর্থ তাঁরা কমিটিকে দেন। নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের তিন বছর পর এমপিওভুক্তির কথা। কিন্তু বছরের পর বছর ঝুলে থেকে তা যখন হয় না তখন প্রতারকচক্র সেই সুযোগটি গ্রহণ করে। আর এমপিওভুক্তির বিষয়টিও কি সহজে হয়? সেখানেও রয়েছে অর্থের খেলা। আমরা সবাই ভান করে থাকি। আমরা ভান করি যে সবই ঠিকঠাকমতো চলছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যার কথা কেউ বলতে গেলেও সমস্যা। এসব ভান করার কারণেও এ ধরনের অপরাধ আমরা শিক্ষাক্ষেত্রে এখন ঘন ঘনই দেখতে পাচ্ছি। এ থেকে জাতিকে পরিত্রাণ পেতে হবে।
লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক