নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যয় বেড়েছে সরকারের, খেসারত অভিভাবকদের

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

নতুন শিক্ষাক্রমে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের খরচও বেড়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের এ শিক্ষক প্রশিক্ষণে ইতোমধ্যে সরকারের প্রায় ২২১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ‘মনিটরিং ও মেন্টরিং’ প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে। এতে ব্যয় আরও বাড়ছে। বিপুল টাকা ব্যয় হলেও প্রশিক্ষণের মান নিয়ে খোদ শিক্ষকদের মধ্যেই নানা প্রশ্ন রয়েছে। 

শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে বলা হয়েছিল- নতুন শিক্ষাক্রমে নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের প্রয়োজন হবে না। কোচিংয়ের পেছনে দৌড়াতে হবে না। কিন্তু হয়েছে উল্টো। নতুন শিক্ষাক্রমে নানা ভুল-ভ্রান্তি, অসঙ্গতি, বিতর্ক, শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণ এবং দুটি বই প্রত্যাহারের কারণে ‘নিষিদ্ধ’ নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের ব্যবসা আরও বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের এখন কোচিং সেন্টারে আরও বেশি দৌড়াতে হচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান এবং শিক্ষকদের পড়ানোর কৌশল ও দক্ষতা ওপর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এতে দেখা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান জানিয়েছেন, তারা নিজেরাই নতুন শিক্ষাক্রম ঠিকমত বুঝতে পারছে না। অনলাইনে নামমাত্র প্রশিক্ষণ নেয়া বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকরাও ঠিকমত আয়ত্ত করতে পারেননি শিক্ষাক্রম।

জানতে চাইলে শরীয়তপুরে নড়িয়া উপজেলার নোয়াপাড়া পাবলিক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল হোসেন মিলন জানান, তার স্কুলের যেসব শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তারাই ঠিকমত তা বুঝতে পারেননি। শিক্ষার্থীদের যথাযথ ধারণা দিতে পারছেন না। এ কারণে শিক্ষার্থীরা নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের ওপর নির্ভর করছে।

নামকাওয়াস্তে প্রশিক্ষণ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মাস্টার ট্রেইনাররাই বলছেন, শিক্ষাক্রম নিয়ে যে ধরণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা দেশে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। নতুন শিক্ষাক্রমে ক্লাশরুমে পাঠদান সীমাবদ্ধ না রেখে উন্মুক্ত শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ স্কুলেই আইসিটি ল্যাব নেই, ল্যাব আছে তো শিক্ষক নেই; ল্যাব চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নেই।’

এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেছেন, ‘যেকোন নতুন বিষয়ের ওপর পূর্ণ ধারণা পেতে একটু সময় লাগতেই পারে। এজন্য আমরা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছি।’

নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে মোট ১০টি করে বই পাঠদান হচ্ছে। বইগুলি হলো- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, ধর্ম এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।

মাউশি জানিয়েছে, সারাদেশের মাধ্যমিক স্তরের প্রায় দুই লাখ ৮১ হাজার শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এছাড়া মাস্টার ট্রেইনার, শিক্ষা কর্মকর্তা, প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সবমিলিয়ে চার লাখের কিছু কম শিক্ষক নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর প্রতিষ্ঠান পাচ্ছেন। তাদের প্রতিদিনের সম্মানী, যাতায়াত ভাড়া, ভ্যানু ভাড়া, আপ্যায়ন এবং এ সংক্রান্ত অন্য শিক্ষা উপকরণ কেনা বাবদ সরকারের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে স্কিম ডকুমেন্ট অনুসারে দেশব্যাপী মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান প্রধানগণের (প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষ/মাদ্রাসা সুপার) ‘কারিকুলাম মনিটরিং এবং মেন্টরিং’ সংক্রান্ত বিষয়ে চারদিনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছে।

এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জেলা পর্যায়ে বাস্তবায়ণ হবে। এজন্য ৬৪টি জেলা শিক্ষা অফিস কর্তৃক সর্বমোট ৩১ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার ১২০ টাকা ‘অগ্রিম উত্তোলন’ করার প্রয়োজন হবে। এই অর্থ ছাড় করতে এখন অর্থবিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে মাউশি মহাপরিচালকের চিঠিতে।

সহায়ক বইয়ের বোঝা বেড়েছে :

জাতীয় শিক্ষাক্রমের রুপরেখা প্রণয়নের সময় শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ‘মুখস্থনির্ভরতা’ কমিয়ে শিক্ষাকে ‘আনন্দময়’ করা কথা বলেছিলেন। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে বুঝে শিখবে এবং সৃজনশীল হয়ে উঠবে। বাস্তবায়নের শুরুতেই হোঁচট খায় এ শিক্ষাক্রম। শিক্ষাক্রম নিয়ে শ্রেণী শিক্ষকরাই নানা রকম প্রশ্ন তুলছেন।

নানা বিতর্কের কারণে এই শিক্ষাক্রমে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের বাণিজ্য শুরু করেছে শিক্ষা ব্যবসায়ীরা। দেশব্যাপী বাজারে দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীসহ সব শ্রেণীর জন্যই মিলছে নোট-গাইড বা সহায়ক বই।

নোট-গাইড বা সহায়ক বই ব্যবসায়ীদের কাছে ‘অনৈতিক সুবিধা’ নিয়ে অনেক শিক্ষক তা পড়তে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয় শিক্ষা প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরা দেখেও না দেখার ভান করছেন।

মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক কাইসার শাকিল বলেন, শিক্ষকের পরামর্শে তিনি তার সন্তানের জন্য ১২শ’ টাকার সহায়ক বই কিনেছেন। পাশাপাশি কোচিং সেন্টারেও যেতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেছেন, ‘কোন শিক্ষার্থীকে নোট-গাইড বা সহায়ক কিনতে বাধ্য করা যাবে না। কোন শিক্ষক এটি করলে.....এবং সে রকম অভিযোগ পাওয়া গেলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেবো।’

নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষানির্ভরতা কমানো হয়েছে। সম্প্রতি মাউশি এক বিজ্ঞপ্তিতে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত কোন পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট না নেয়ার কথা জানিয়েছে। এরপরও অনেক স্কুলে নানাভাবে পরীক্ষা নিচ্ছে। বাড়তি বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।

রাজধানীর বাংলাবাজারের বইয়ের বাজার সম্প্রতি ঘুরে দেখা গেছে, দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য প্রকাশ্য নোট-গাইড বিক্রি হচ্ছে। আকর্ষণীয় মোড়কে ‘একের ভেতর সব’- নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর নোট-গাইড বা সহায়ক বই বাজারে এসেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি গড়ে উঠা লাইব্রেরিতেও বিক্রি হচ্ছে এসব নোট-গাইড বই।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নিউটন, অনুপম, চ্যান্সেলর, দিকদর্শন, পাঞ্জেরী, লেকচার, সংসদ, আদিল, ফুলকুঁড়ি প্লাস, ইন্টারনেট, অ্যাকটিভ চমক, দিগন্ত, ক্লাসফ্রেন্ড, ক্যাপ্টেনসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর সহায়ক বই বিক্রি হচ্ছে।

এ বিষয়ে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল বলেন, তারা নোট-গাইড নয়, সহায়ক বই ছেপে বিক্রি করছেন। এগুলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দাবির প্রেক্ষিতেই তারা বাজারজাতকরণ করেছেন।

নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষকরা বুঝতে না পারার কারণেই ‘সহায়ক বই’ তারা প্রকাশ করেছেন জানিয়ে পুঁথিনিলয় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী শ্যামল পাল বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়েছে জানুয়ারিতে। আমরা সহায়ক বই বাজারে এনেছি মার্চে। যাদের এগুলো প্রয়োজন তারা কিনবে; আমরা কাউকে জোর করছি না।’

শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, শিক্ষা আইন না হওয়ার কারণে গাইড বা সহায়ক বইয়ের দৌরাত্ম্য ঠেকানো যাচ্ছে না। আর এই শিক্ষা আইন না হওয়ার পেছনে নোট-গাইড প্রকাশকরা কলকাঠি নাড়ছেন। এ থেকে শিক্ষা প্রশাসনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা সুবিধা ভোগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

‘নতুন শিক্ষাক্রম চলবেই’ জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ২৩ মার্চ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘কেউ কেউ মনে করছেন নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলে কোচিং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, নোট-গাইড ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা ভেতরে ভেতরে অনেক অপপ্রচার করছেন, শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করছেন।’

সূত্র : দৈনিক সংবাদ 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও - dainik shiksha ‘ভুয়া প্রতিষ্ঠাতা’ দেখিয়ে কলেজ সভাপতির প্রস্তাব দিলেন ইউএনও বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল - dainik shiksha বেরোবি শিক্ষক মনিরুলের নিয়োগ বাতিল এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক - dainik shiksha এমপিও না পাওয়ার শঙ্কায় হাজারো শিক্ষক কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকতা করা আরো ৩ জন চিহ্নিত এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন - dainik shiksha এসএসসি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ফরম পূরণের পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞপ্তি দেখুন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031161308288574