নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশে বর্তমানে ১৬-৬৪ বছর বয়সি কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমরা এ জনমিতিক সুফল পেতে চাই, কারণ এরপর আমাদের বর্ষীয়ান নাগরিকের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে।  শনিবার (১৬ অক্টোবর) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, কাজেই বাংলাদেশের এ বিপুল জনগোষ্ঠী, যাদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে তাদের শিক্ষায়, চাকরি ক্ষেত্রে ও সমাজে একীভূত করতে না পারলে জনমিতিক সুফল অর্জন সম্ভব নয়। আবার দেশের নৃগোষ্ঠীর শিশুদের প্রায় ২০ শতাংশ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। নানা বৈষম্যের কারণে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর থেকে ঝরে পড়ছে বিপুলসংখ্যক শিশু।

তাছাড়া সার্বিকভাবে উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩১ শতাংশ নারী। কাজেই বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীকে দক্ষ, উৎপাদনশীল ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন না করতে পারলে দেশের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। মানুষের মাঝে বৈচিত্র্য, চাহিদা, সক্ষমতা, আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, লিঙ্গগত, ভাষাগত, নৃতাত্ত্বিক পরিচিতির ভিত্তিতে নানাবিধ বৈষম্য বিদ্যমান।

দেশের সব নাগরিককে সমঅধিকারের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে উৎপাদনশীল করতে পারলেই পরিপূর্ণ জনমিতিক সুফল অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১-এর উন্নত বিশ্বের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ যেহেতু শিক্ষায় বড় সংস্কার আনার পরিকল্পনা করছে, তাই এর কাছে প্রত্যাশাও বেশি। এজন্য জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় এসব বৈচিত্র্য বিবেচনা করে কী কী পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা উপলব্ধি করা জরুরি।

শিশুদের শিক্ষায় নিয়ে এলেই ইনক্লুশন অর্জিত হয় না। তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে কিনা, শিখন শেষে যে যোগ্যতা অর্জন করার কথা, তা অর্জিত হচ্ছে কিনা এবং সব মানুষ তাদের ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছে কিনা- এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল ইনক্লুশন অর্জন সম্ভব।

অতীতেও দেখা গেছে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে (বৃত্তি, সচেতনতা সৃষ্টি, অভিভাবকদের সহায়তা) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া, মূল্যায়ন ও শিখন পরিবেশ শিশুর সামর্থ্য, বৈচিত্র্য, প্রবণতা ও চাহিদা অনুযায়ী না সাজানোর কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমানো যায়নি। ফলে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের (যেমন, প্রতিবন্ধী, কর্মজীবী শিশু) ভর্তির হারও একটা সময় পর কমতে শুরু করেছে।

শিক্ষাক্রম রূপরেখার একটি শক্তিশালী দিক হলো, এতে সব শিশুকে ইনক্লুশনের লক্ষ্যদল হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এ রূপরেখা শিশুর মাঝে বিভিন্ন সমস্যা (যেমন- প্রতিবন্ধী, দরিদ্রপীড়িত, ভিন্ন ভাষা, লিখতে না পারা) খোঁজার বিতর্কিত সীমাবদ্ধতা মতবাদকে (Deficit view) ছুড়ে ফেলে শিশুর বৈশিষ্ট্যকে তার বৈচিত্র্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় ইনক্লুশনের ন্যায্যতামূলক মতবাদকে (Equitable view) সমর্থন করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীর সমস্যার পরিবর্তে তাদের বৈচিত্র্য অনুযায়ী চাহিদা পূরণে শিক্ষাব্যবস্থা ও কাঠামোর সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করা হয়। যেমন, সব শিক্ষার্থীর সামর্থ্য বিবেচনা না করে শিখন যোগ্যতা নির্ধারণ করা, শিক্ষকের সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতা, ভাব বিনিময়ের বিকল্প সুযোগ না রাখা এবং সর্বোপরি শিখন-শেখানো কৌশল, শিখন পরিবেশ, মূল্যায়ন কৌশল, শিখন উপকরণ, শিক্ষা নীতিমালা, কাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় নমনীয়তা না থাকা।

এবার আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক শিক্ষাক্রম রূপরেখায় ইনক্লুশনের ন্যায্যতামূলক মতবাদকে কীভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমেই দেখা যাক যোগ্যতা নির্ধারণের বিষয়টি। যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে যোগ্যতা নির্ধারণের সময় যদি শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, বৈচিত্র্য, প্রবণতা ও চাহিদা বিবেচনার সুযোগ না থাকে, তাহলে যোগ্যতার ধরনই বৈষম্য তৈরি করতে যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, একটি যোগ্যতা যদি হয়, নির্দেশনা শুনে সহজ শব্দ ও বাক্য লিখতে পারা, তাহলে একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে কোনো শিক্ষার্থীর যদি শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা থাকে অথবা শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে সে লিখতে না পারে, তাহলে তার পক্ষে এ যোগ্যতা অর্জন কোনোদিনও সম্ভব হবে না।

এ যোগ্যতাটিকেই যদি এভাবে বলা হয়, নির্দেশনাকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব ও উপলব্ধি করে একাধিক সহজ বাক্যে ভাব প্রকাশ (লেখা, আঁকা, ব্রেইল...) করতে পারা- এর ফলে পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উপলব্ধি করার বিষয়টি উল্লেখ থাকায় কোনো শিক্ষার্থীর শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা থাকলেও অন্য ইন্দ্রিয় (যেমন, দৃষ্টি বা স্পর্শ) ব্যবহার করে সে নির্দেশনাটি বুঝতে পারবে। একইভাবে বাক্য লিখে প্রকাশের পাশাপাশি আঁকা, ব্রেইল ইত্যাদি উপায়ে প্রকাশের সুযোগ রাখার ফলে শিক্ষার্থীর লিখতে চ্যালেঞ্জ থাকলেও যোগ্যতা প্রকাশের বিকল্প উপায় থাকবে।

আবার বহুমুখী বুদ্ধিমত্তার ধারণা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষার্থী লিখে যোগ্যতা প্রকাশ করার জন্য আগ্রহী না হলে তার সবল দিকটি চর্চার মাধ্যমে লেখার বিকল্প উপায়ে ভাব প্রকাশের সুযোগ পাবে। শিক্ষাক্রম রূপরেখায় এভাবেই অনুভব ও উপলব্ধি করা এবং তা বহুমুখী উপায়ে প্রকাশের বিষয়টিকে বিভিন্ন শিখনক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণে অনুসৃত হওয়ায় শিক্ষার্থীর সামর্থ্য, বৈচিত্র্য, প্রবণতা ও চাহিদার বিষয়গুলো সঠিক উপায়ে পূরণের পথ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব দেশে শিক্ষাক্রম পরিমার্জন হয়েছে (যেমন- ফিলিপাইন, নিউজিল্যান্ড), সেসব দেশেও যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বহুমুখী গ্রহণ ও প্রকাশকে বিবেচনা করা হয়েছে।

শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ অনুযায়ী শিখন আর মুখস্থনির্ভর হচ্ছে না। ফলে পড়ালেখা আর শুধু শ্রেণিকক্ষের মধ্যে আবদ্ধ থাকছে না, বরং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে ঘটবে। প্রয়োজন অনুযায়ী একক, জোড়ায় বা দলে বিভক্ত করে হাতে-কলমে শিখন, প্রকল্পভিত্তিক, সহযোগিতামূলক, স্ব-প্রণোদিত শিখনের সংমিশ্রণ করা হবে- যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, পরিবার ও এলাকার লোকজনেরও সংশ্লিষ্টতা থাকবে।

এর ফলে একজন পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়ায় সতীর্থ, অভিভাবক ও পরিবারের সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাছাড়া অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা বহু ইন্দ্রিয় ব্যবহার ও তাদের সামর্থ্য ও প্রবণতা অনুযায়ী শিখন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়ায় তাদের বিশেষ শিখন-চাহিদা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। রূপরেখায় অতি মেধাবী শিশুদের শিখন-চাহিদা, সক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় এনে তাদের বয়সের সীমায় আটকে না রেখে অগ্রগামী-শিখনের (accelerated-learning) বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে (যেমন- গণিত, বিজ্ঞান বা সাহিত্য অলিম্পিয়াড) দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার উপায় রাখা হয়েছে।

শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে লিখিত পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নের বদলে আরও বৃহৎ পরিসরে মূল্যায়নকে ভাবা হয়েছে, যেখানে শিক্ষককেন্দ্রিকতার বদলে শিক্ষার্থী নিজে, শিক্ষক, অভিভাবক, পরিবার ও এলাকার লোকজনকেও সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর ফলে প্রতিবন্ধী ও অতিমেধাবী শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।

নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুযায়ী, নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষাভিত্তিক শিখনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ, দুর্যোগের সময় শিক্ষার ধারাবাহিকতাসহ বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের বিকল্প নমনীয় উপায় নির্ধারণ সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে শিশু যাতে নিজের জেন্ডার পরিচিতি (ছেলে, মেয়ে, তৃতীয়/রূপান্তরিত লিঙ্গ) নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবেশ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শিখন অর্জন করতে পারে, সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কাজেই এটা আশা করা যেতেই পারে যে, জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ, সহমর্মিতা, সম্প্র্রীতি, বৈচিত্র্যকে সম্মান ইত্যাদি গুণসম্পন্ন অভিযোজনে সক্ষম, সুখী এবং বিশ্ব নাগরিক তৈরি হবে- যারা সাম্য, ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে।

লেখক : ড. এম তারিক আহসান, অধ্যাপক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল কাল - dainik shiksha এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল কাল কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগের ভাইভা শুরু - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগের ভাইভা শুরু এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল জানবেন যেভাবে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ঢাবিতে মাস্টার্সেও পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির কথা ভাবা হচ্ছে: ভিসি - dainik shiksha ঢাবিতে মাস্টার্সেও পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তির কথা ভাবা হচ্ছে: ভিসি উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় ফের বৃদ্ধি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026979446411133