নতুন শিক্ষাক্রমে সাত স্তরের মূল্যায়নে অস্পষ্টতা

মাছুম বিল্লাহ |

বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে পড়ছেন, তারা প্রথমবারের মতো নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দে। এর পরের বছর থেকে সামষ্টিক মূল্যায়নের মতো ডিসেম্বরেই এসএসসি পরীক্ষা নেয়ার যায় কি না ভাবনাও চলছে। নতুন শিক্ষাক্রমে এখনকার মতো পরীক্ষা হবে না। বর্তমানে মূলত দশম শ্রেণিতে নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে নির্বাচনী পরীক্ষা হবে না। যেসব শিক্ষার্থী নবম শ্রেণি শেষ করে দশম শ্রেণিতে উঠবেন, তারাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবেন।

কোনো শিক্ষার্থী যদি দশম শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ কর্মদিবসে উপস্থিত না থাকেন, তাহলে তিনি পাবলিক মূল্যায়ন বা এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবেন না। স্কুলগুলো এই শর্ত কতোটা মানতে পারবে তা সময়ই বলে দেবে। আর কোনো শিক্ষার্থী যদি এসএসসি পরীক্ষায় এক বা দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হন, তাহলে শর্ত সাপেক্ষে একাদশ শ্রেনিতে ভর্তির সুযোগ পাবেন। তবে তাকে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিষয়ে পাস করতে হবে। আর তিন বা তার বেশি বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হলে একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না।

নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ (গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ) বা অন্য কোনো গ্রেডিং থাকছে না। এমনকি ত্রিভুজ, বৃত্ত বা চতুর্ভূজ দিয়েও মূল্যায়ন করা হবে না। শুধু বিষয়ভিত্তিক পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর দেয়া হবে। আর প্রত্যেক বিষয় মূল্যায়নে সাতটি পর্যায় বা স্কেল দেয়া হবে। তবে সব বিষয়ের স্কেল মিলিয়ে তা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করা হবে না। 

বার্ষিক ও অর্ধবার্ষিক (ষাণ্মাষিক) মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সাতটি ধাপ বা স্কেলে নির্ধারণ করার কথা বলা হচ্ছে। যে সাতটি স্কেলে মূল্যায়ন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো-প্রারম্ভিক, বিকাশমান, অনুসন্ধানী, সক্রিয়, অগ্রগামী, অর্জনমুখী ও অনন্য। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ওপর ভিত্তি করে এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হবে। লিখিত ও মূল্যায়নের ওয়েটেজ ৬৫ শতাংশ এবং কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নে থাকবে ৩৫ শতাংশ। পরীক্ষা হবে ৫ ঘণ্টাব্যাপী। পাবলিক পরীক্ষায় মোট ১০টি বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। এতে থাকবে লিখিত পরীক্ষাও। প্রতিটি বিষয়ের মূল্যায়নে বিরতিসহ ৫ ঘণ্টা পরীক্ষাকেন্দ্রে থাকতে হবে শিক্ষার্থীদের। বর্তমান সময়ের মতো আলাদা পরীক্ষা কেন্দ্রে মূল্যায়নে অংশ নেবেন শিক্ষার্থীরা। দশটি বিষয় হচ্ছে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, জীবন ও জীবিকা, ধর্মশিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিল্প ও সংষ্কৃতি। এসএসসি পরীক্ষা নেয়ার সার্বিক আয়োজনের জন্য বিষয়ভিত্তিক ৬০০ শিক্ষকের সমন্বয়ে রিসোর্সপুল (বিশেষজ্ঞ দল) গঠন করা হবে। প্রথমে তাদের বোর্ডের আয়োজনে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। আর ১১টি শিক্ষাবোর্ডের প্রতিটির জন্য প্রতি বিষয়ে চারজন করে মোট ৪৪ জন শিক্ষককে চূড়ান্ত করা হবে। 

একেকটি বিষয়ে কয়েকটি পারদর্শিতার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। কোনো বিষয়ে একের বেশি পারদর্শিতার ক্ষেত্রে ‘প্রারম্ভিক’ স্তরে থাকলে শিক্ষার্থী ওই বিষয়ে উত্তীর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবেন না। আর যদি কোনো বিষয়ে দুইয়ের বেশি (তিন বা তার ততোধিক) পারদর্শিতার ক্ষেত্রে ’বিকাশমান’ বা তার নিচের স্তুরে থাকেন তাহলেও সে বিষয়ে উত্তীর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবেন না।

এ ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী যদি তিন বা তার বেশি বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হন, তাহলে পরবর্তী শ্রেণিতে (একাদশ) উত্তীর্ণ হবেন না। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী এক বা দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হলে শর্ত সাপেক্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবেন। তবে, দুই বছরের মধ্যে অনুত্তীর্ণ বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে না পারলে তিনি নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারবেন না। এরপরও তার সুযোগ থাকবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে অনুত্তীর্ণ হওয়া বিষয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবেন। এই শর্ত শিখনকালীন ও সামষ্টিক উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এ ছাড়া উত্তীর্ণ বা শর্ত সাপেক্ষে উত্তীর্ণ কোনো শিক্ষার্থী মান উন্নয়নের জন্য এক বা একাধিক বা সব বিষয়ে পুনরায় পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। 

এদিকে এই শিক্ষাক্রমকে উন্নতির নামে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি বেখাপ্পা ও ধ্বংসাত্মক বলে দাবি করে সচেতন অভিভাবক সমাজ। তারা গত ৩১ মে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনে এ কথা বলেন। তারা বলেন, আজ করিকুলাম চালু হওয়ার দেড় বছরের মাথায় সারা দেশের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, তথাকথিত স্মার্ট নাগরিক বানানো, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বানানোর এই কারিকুলামের মাধ্যমে যেটুকু লেখাপড়া ছিলো তাও শেষ হয়ে গেছে। প্রতিদিন নিত্য-নতুন নির্দেশনা দেয়া ও বাতিল করা, কীভাবে পরীক্ষা হবে এবং মূল্যায়ণ হবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতা ও হ-য-ব-র-ল নির্দেশনায় শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা আজ অসহায়, অভিভাবকরা নিরুপায়। এই পরিস্থিতি থেকে অভিভাবক ও শিক্ষক সমাজ নিস্কৃতি চায়। আমাদের সন্তানদের জন্য ভালো মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আগে ভালো শিক্ষক দরকার, তাদের ভালো বেতন দরকার, ভালো প্রশিক্ষণ দরকার, তাদের স্বাধীনতা দরকার, স্কুল-কলেজের ওপর থেকে দুর্বৃত্ত ব্যবস্থাপনা কমিটির অপসারণ দরকার, প্রশাসনিক হয়রানি থামানো দরকার। কিন্তু তা না করে প্রতিনিয়ত শিক্ষার উন্নয়নের নামে যা করা হচ্ছে তাতে শিক্ষার আরো পতন ঘটছে। 

সাতটি স্কেলে যে মূল্যায়নের কথা বলা হচ্ছে, এখানে রয়েছে বিশাল গ্যাপ, ঘাপলা ও বিরাট অস্পষ্টতা। তার কিছুটা এখানে তুলে ধরা হলো। এখানে বৃত্তের মান শূন্য এবং চতুভুর্জের মান নেতিবাচক ধরা হয়েছে। তাহলে শুধু ত্রিভুজের মান ইতিবাচক যোগ্যতা হিসেবে গণ্য হবে। অন্যদিকে বৃত্তের মান শূন্য হওয়ায় তা গণনায় আসবে না এবং চতুর্ভুজের মান নেতিবাচক হওয়ায় অর্জিত ত্রিভুজের মান থেকে বাদ যাবে। ফলে শূন্যের নিচে ফলাফলকে নেতিবাচক পারদর্শিতা হিসেবে ধরা হবে। এ ধরনের ফর্মুলায় পৃথিবীর কোথাও যোগ্যতা বা পারদর্শিতা পরিমাপ করা হয় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বা পারদর্শিতা মূল্যায়নে গ্রেডিং পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই গ্রেডিং পদ্ধতিতে যোগ্যতা বা পারদর্শিতা মূল্যায়ন করা হয়। যে ফর্মুলায় বাংলাদেশে যোগ্যতা মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটিকে ‘discrimination index formula’ বলা হয়। এই ফর্মুলা দিয়ে পৃথিবীর কোথাও শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বা পারদর্শিতা হিসাব করা হয় না। ‘discrimination index formula’-দিয়ে বড় আকারে পরীক্ষা যেমন জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন (এনএসএ) এর জন্য কয়েক সেট প্রশ্নের মধ্যে কোন প্রশ্নগুলো কঠিন আর কোন প্রশ্নগুলো সহজ তা যাচাই করে পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন চূড়ান্ত করা হয়। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বা পারদর্শিতাকে নেতিবাচক মান দিয়ে প্রকাশ করার ধারণা পৃথিবীর কোথাও নেই।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056638717651367