নতুন শিক্ষাক্রম : বিজ্ঞানের সংকোচন কী দেবে!

মাছুম বিল্লাহ |

আগামী বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীরা অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যবই হাতে পেতে যাচ্ছেন। নতুন কারিকুলামের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো- নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীরা এতো দিন যেভাবে মানবিক, বিজ্ঞান কিংবা ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়তেন সেটি আর থাকছে না। সব শিক্ষার্থীকেই বাধ্যতামূলকভাবে সাধারণ দশটি বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। বিষয়টি একমুখী শিক্ষা নামেও পরিচিত। এটি ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দেও তৎকালীন সরকার চালু করতে চেয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় ও শিক্ষাবিদদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বাদ দেয়া হয়েছিলো। নতুন কারিকুলাম শুরুর আগে কোভিডকালীন ও কোভিড শুরুর আগেও এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এ নিয়ে কয়েকবার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও কথাবার্তা হয়েছে। আমি বলেছিলাম, একমুখী শিক্ষা কিংবা  নবম শ্রেণি থেকে নো-গ্রুপ বিভাজন বিষয়টি কিন্তু সেই ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের আগের। আমরা এতো বছর পরে আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাবো!  এনসিটিরিব একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তখন বলেন, আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শেখাচ্ছি আর তারা বুয়েট, চুয়েট থেকে পাস করে সার্ভ করছে যুক্তরাষ্ট্রকে। আমি বলেছিলাম, এটি কেমন কথা? আমাদের শিক্ষার্থীরা বুয়েট থেকে পাস করে বিদেশে চলে যায় তাই আমরা তাদের বিজ্ঞান শিক্ষায় নিরুৎসাহিত করবো?

তারা যেহেতু বিষয়টি চালু করার ক্ষমতা রাখেন বিষয়টি তারা চালু করলেনই। কিন্তু এর গভীরে ঢুকলে দেখা যায়, মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিভাগভিত্তিক বিজ্ঞান বিষয়ে অন্তত ৪০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়টি তারা মোটামুটি জানার সুযোগ পেতেন। রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ইত্যাদির মধ্য থেকে যেকোনো একটিকে বাধ্যতামূলক ও একটি ঐচিছক বিষয় হিসেবে বেছে নিতেন শিক্ষার্থীরা। 

নতুন কারিকুলামে বিষয়গুলোকে একীভূত করে যা দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে- শিক্ষার্থীরা এখন মাত্র ১০০ নম্বরের বিজ্ঞান পড়বেন।  বিজ্ঞানের এই যুগে, বিশেষায়ণের এই যুগে, বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের একেবারেই সংকুচিত জ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করবেন! কোনো কোনো শিক্ষাবিদ এটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু যখন এই কারিকুলাম চালু হয় তখন তারা অনেকেই সায় দিয়েছিলেন। আমরা বলেছিলাম, এতো বড় পরিবর্তন একলাফে আনা ঠিক হবে না। মুখে বলছি শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানমুখী হবেন আর বিজ্ঞান পড়াবো না, বিজ্ঞানের সবদিক সংকুচিত করে ফেলবো। এটি বিপরীতমুখী কথা হলো না? এমনিতেই আমাদের শিশুরা বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষায় অনাগ্রহী। কারণ, বিজ্ঞানকে আকর্ষণীয়ভাবে, ভালো কনসেপ্ট দিয়ে পড়ানোর মতো শিক্ষকস্বল্পতা, বিজ্ঞানাগারের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব। অথচ বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞান শিক্ষাকে আমরা কতোভাবে উৎসাহিত করতে পারি সেটি নিয়ে পদ্ধতি বের করা প্রয়োজন। সেটি না করে আমরা নতুন কারিকুলামে বিজ্ঞানকে প্রায় সরিয়ে ফেলেছি। 

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রেষণে নিযুক্ত এনসিটিবির ওই কর্মকর্তা আরো বলেছিলেন, ‘বর্তমানে যারা মানবিক বিভাগে পড়েন তারা বিজ্ঞান জানেন না, যারা বিজ্ঞান পড়েন তারা সাহিত্য জানেন না, যারা ব্যবসা শিক্ষায় পড়েন তারা ইতিহাস জানেন না। এবার নতুন কারিকুলামে সবাই সব জানবেন।’ এটি কেমন কথা। সবাই সবটা জানবেন না, জোর করে জানানোও যাবে না। বিজ্ঞানের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে তারা বিজ্ঞান পড়বেন, কিন্তু অনেক বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সাহিত্য নিজ ইচ্ছায় পড়েন। অনেক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী পড়ার চাপের মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের বহু বই পড়ে ফেলেন। অনেক ইঞ্জিনিয়ার সাহিত্যের অনেক বই পড়েন। যাদের যেদিকে আগ্রহ আছে এবং যারা পড়ে ডাইজেস্ট করতে পারেন, তারা সেসব পড়বেনই। জোর করে সবাইকে সব পড়ানোর  চেষ্টা অযৌক্তিক। এই কারিকুলামে আমরা যা করছি তা হচ্ছে যারা বিজ্ঞান পড়তে ভালোবাসবেন না, বা আগ্রহ নেই বা পড়ে বুঝবেন না তাদেরও বিজ্ঞান পড়া আর যারা বিজ্ঞান বিস্তারিতভাবে পড়তে আগ্রহী তাদের আমরা ইচ্ছে করেই দমিয়ে রাখবো। বিষয়টি কেমন হলো? আমরা শুধু বলতেই পারি। আমাদের আর কী করার আছে? কিন্তু শিক্ষার্থীদের, ভবিষ্যৎ বংশধরদের যে ক্ষতিটা হচ্ছে এবং গভীর ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে তার দায়ভার কে বা কারা নেবেন? 

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তাকালে দেখা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য এগারোটি বিষয়ে মোট এক হাজার নম্বরের পরীক্ষা হতো। এর মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য মোট নম্বর ছিলো ৩০০, যা মোট নম্বরের ৩০ শতাংশ। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসিতে বিষয় ছিলো এগারোটি, নম্বর ছিলো এগারো শত। তার মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য বরাদ্দকৃত নম্বর ছিলো ৪০০। ওই সময়ে মোট নম্বরের ৩৬ শতাংশ ছিলো বিজ্ঞানে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মোট বিষয় ছিলো ১৪টি। এর মধ্যে বিজ্ঞানের জন্য মোট নম্বর ছিলো ৪০০ অর্থাৎ মোট নম্বরের ৩১ শতাংশ। 

নুতন কারিকুলামে নবম-দশম শ্রেণিতে মোট বিষয় রাখা হয়েছে দশটি। এক হাজার নম্বরের পরীক্ষায় বিজ্ঞানে থাকছে ১০০ নম্বর অর্থাৎ মোট নম্বরের ১০ শতাংশ। 

নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নে উচ্চতর পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো কমার আশঙ্কা রয়েছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এতোদিন ধরে নবম-দশম শ্রেণিতে পৃথকভাবে তুলনামূলক বড় পরিসরে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের মতো বিষয়গুলোয় পড়াশুনা করতেন। মাধ্যমিকের পর যতো উপরের স্তরে যাবে, বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার ততো কমে যেতে পারে। কাজেই মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সংকোচন করার প্রভাব অনেক বেশি এবং সুদূরপ্রসারী। 

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছরে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থীর হার ছিলো যথাক্রমে ৩১ শতাংশ, ৩১ দশমিক ৯৪, ৩০ দশমিক ৯২, ২৮ দশমিক ১৯ ও ৩১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এ হার অনেকখানি কমে গেছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছরে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের পরিক্ষার্থী ছিলেন যথাক্রমে ২২ দশমিক ২৯ শতাংশ, ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ, ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ২৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক পর্যায়ের চূড়ান্ত পরীক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোর অংশ নেয়া পরীক্ষাথীর হার ছিলো ১৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে এই হার ছিলো ১৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে এর হার দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। যদিও কোভিডের কারণে এটি হয়েছিলো। কিন্তু চিত্র তো বলে দিচ্ছে যে, বিজ্ঞান শিক্ষার কী হাল আমাদের দেশে!

এসব বিষয়ে এনসিটিবি বলছে, এ শিক্ষাক্রমের নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ের অধীনে অনুপাত ও পরিমাণ, সিস্টেম, সিস্টেমের আভ্যন্তরীণ সজীব এবং বস্তুগুলোর গঠন ও আচরণ, পদার্থের গঠন ও আচরণ, বস্তু ও শক্তির মিথস্ক্রিয়া, স্থিতি ও পরিবর্তন, জীববিজ্ঞান এবং পৃথিবী ও মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে পাঠ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় এমনভাবে পড়ানো হবে যাতে তারা বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জন করে, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে আগ্রহী হয় এবং তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানকি দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। এটিতো সেই আশার কথা, ভাবনার কথা। কিন্তু বাস্তবতা কী? সকল শিক্ষার্থীই কি এগুলো বুঝার পর্যায় থাকবেন যে, সকলের জন্যই বিজ্ঞানের একই বিষয়? এমনভাবে পড়ানো হবে? কে পড়াবেন এমনভাবে? সব বিদ্যালয়ে কি এমন বিজ্ঞান শিক্ষক আছেন?

চীনে ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সে জুনিয়র মাধ্যমিক স্কুল সম্পন্ন করতে হয়। যেখানে শিক্ষার্থীদের গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো তুলনামূলক বিস্তারিতভাবে শেখানো হয়। ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দে অধ্যায়ন করতে পারেন এবং তারা সে অনুযায়ী বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান  ও কলা বিভাগের যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। এভাবে বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর অনেক দেশেই মাধ্যমিক পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয় নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে এবং সমন্বিত বিজ্ঞান শিক্ষার পরিবর্তে পৃথকভাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন  ও গণিত পড়ানো হয়। 

কিন্তু আমাদের হচ্ছে কী? ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ কেটে গেলো, নভেম্বরে শিক্ষার্থীরা তাদের ফল পাবেন। কিন্তু পুরো বছরে লিখিত কোনো পরীক্ষাই হলো না, সবটাই শিক্ষকরা বুঝে আর না বুঝে সার্কেল, চতুর্ভুজ আর পিরামিড দিয়েছেন। 

কোনো বিষয়ে কী জানলেন সেটির প্রকাশ করার জনপ্রিয় মাধ্যমে হচ্ছে লিখে প্রকাশ করা। লিখে প্রকাশ করা মানে ভাষাজ্ঞান দেখা, ধারণা কতোটা পেলেন সেটি দেখা, একটি বিষয় গুছিয়ে কতোটা লিখতে পারে একজন শিক্ষার্থী ইত্যাদি দেখা, কীভাবে যুক্তি, তর্ক, উপস্থাপন এবং মনের ভাব সুন্দরভাবে প্রকাশ করা এ সবগুলোরই কাঙিক্ষত মাধ্যম হচ্ছে লেখা। দৈহিক ভাষা, মুখের ভাষাও একটি অংশ থাকবে, কিন্তু সেটি সব নয়। এখন দেখা যাচ্ছে আসল বিষয়কে আমরা সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যটিকে বেশি জোর দিচ্ছি। এতে কি আমাদের জাতীয় মূল কারিকুলামে ভবিষ্যৎ বংশধরদের যেভাবে বেড়ে ওঠার কথা, সেটি অর্জিত হবে?

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ক্যাডেট কলেজের সাবেক অধ্যাপক 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির লিখিত পরীক্ষা ২৩ ডিসেম্বর - dainik shiksha আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির লিখিত পরীক্ষা ২৩ ডিসেম্বর তালাবদ্ধ কেন্দ্রে হবে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha তালাবদ্ধ কেন্দ্রে হবে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে মরিয়া সেই অধ্যাপক - dainik shiksha মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে মরিয়া সেই অধ্যাপক ৩৫ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত, পাস মাত্র চার - dainik shiksha ৩৫ শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত, পাস মাত্র চার এইচএসসির ২ লাখ ৭১ হাজার খাতা চ্যালেঞ্জ - dainik shiksha এইচএসসির ২ লাখ ৭১ হাজার খাতা চ্যালেঞ্জ আইনে মৃত কখন - dainik shiksha আইনে মৃত কখন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055990219116211