নতুন শিক্ষাক্রম বৈষম্য কমাবে

সাধন সরকার |

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছেই। অনেকে এর সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে ভাসা ভাসা জ্ঞানে বিরূপ মন্তব্য করছেন। নতুন কারিকুলামে অনেকগুলো ভালো দিকের একটি হলো- এটি সার্বিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য কমাবে। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের আগে এই বঙ্গীয় ভূখণ্ডে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন ছিলো না। ৬১ বছর পর এসে আবার একমুখী শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে চালু হলো। মাধ্যমিক পর্যায়ে অভিন্ন বর্তমান শিক্ষাক্রম নানা দিক থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে। আশপাশে কান পাতলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে নানা ধরনের কথা শোনা যায়।

অমুক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো, তমুক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খারাপ, ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুধু পরীক্ষা নেয়- আরো কতো কিছু! নতুন কারিকুলামে রুটিন, ক্লাস ও মূল্যায়ন সব সরকার থেকে নির্ধারিত। গ্রামের একেবারে মফস্বলের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সময়ে যে ক্লাস, শহরের একটি নামকরা স্কুলেও একই সময়ে একই ক্লাস অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন পদ্ধতি কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত।

এমনকি ইংরেজি ভার্সন ও মাদরাসায় পড়লেও একই কাজ করতে হচ্ছে। গ্রামের বা শহরের কোনো একটি বিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে ধারণ ক্ষমতার বা শিক্ষকের তুলনায় তিন কিংবা চারগুণ শিক্ষার্থী। অপরদিকে দেখা যাচ্ছে, তার পাশের অপর একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়েও ব্যাপকমাত্রায় বৈষম্য বিরাজমান। নতুন কারিকুলামের মাধ্যমে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে একীভূত শিক্ষা ও মুল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে।

আবার অনেক সময় দেখা যেতো, গ্রাম পর্যায়ে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষকের সংকট থাকায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতো। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ওপর ভিত্তি করে ভালো কিংবা খারাপের তকমা দেয়া হতো! কিন্তু নতুন কারিকুলামে পরীক্ষার চাপ ও সরাসরি বিভাজন তুলে দেয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা এ ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্তি পাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা কমিয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যার ফলে বেসরকারি নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়েও পাঠ্যপুস্তকের ভিন্নতা দূর হবে। 

অনেক শিক্ষার্থী ইচ্ছা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলো প্রাইভেট বা কোচিং করা লাগতো বলে বিজ্ঞান বিভাগ নিতে সাহস পেতো না। আবার অনেক শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার আগে অর্থ খরচের ভয় দেখানো হতো। অনেককে ফেল করানোর ভয় দেখানো হতো।

শিক্ষাজীবনের শুরুতে শিক্ষার্থীর মনোজগতে এই যে বিভাগ বিভাজনের নামে তথাকথিত খারাপ বা ভালো, আলাদা করে ফেলা- এই ধরনের বৈষম্য শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কতোটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? একজন আদর্শ শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা কখনো ভালো কিংবা খারাপের তকমা পেতে পারে না। কেননা শিক্ষকের নৈতিকতার জায়গা থেকে দেখলে সকল শিক্ষার্থী সমান- সে হোক মেধাবী বা তুলনামূলক কম মেধাবী ! 

পড়ালেখার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ভালো। কিন্তু সে প্রতিযোগিতা যখন অসুস্থ কায়দায় বা যেকোনো মূল্যে স্বার্থসিদ্ধির জন্য হয় তাহলে তা সার্বিকভাবে কল্যাণ বয়ে আনে না। শুধু পরীক্ষা ও সার্টিফিকেট নির্ভর শিক্ষাপদ্ধতিতে ধনী পরিবারের একজন শিক্ষার্থী চাইলে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য অর্থের বিনিময়ে বিষয়ভিত্তিক প্রাইভেট বা কোচিং করতে পারেন কিন্তু অপেক্ষাকৃত গরিব ঘরের মেধাবী একজন শিক্ষার্থী চাইলেও সেটা করতে পারেন না।

ফলে সার্বিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হচ্ছিলো। জাতি হিসেবে আমাদের এগিয়ে যেতে হলে কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সব শিক্ষার্থীরাই রাষ্ট্রের সম্পদ। সব শিক্ষার্থীদের একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রের লক্ষ্য। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কর্মসংস্থানের পথ বা উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সুগম করতে পারাই শিক্ষার অনেকগুলো লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের একটি।

নতুন কারিকুলামে কোচিং শিক্ষা লাগবে না। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই কমপ্লিট হবে। ফলে বাড়তি টাকা ও সময় ব্যয় করতে হবে না শিক্ষার্থীদের। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস পাবে। 

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় সমস্যা। একীভূত শিক্ষার মাধ্যমে একই শিক্ষা চালু করার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভারসাম্য ধীরে ধীরে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আনা সম্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেখানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয়ভাবে সরকার শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে, একই বই, একই পড়াশোনা ও একই মূল্যায়ন মেনে শিখন-শেখানো কার্যাবলি পরিচালিত হচ্ছে সেখানে বৈষম্য থাকার সুযোগ নেই।

শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদা। সবার-ই অধিকার আছে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে কিংবা এলাকাভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পরীক্ষা নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের ব্যবস্থা নতুন কারিকুলামে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে গ্রাম-শহর, ধনী-গরিব, সরকারি-বেসরকারি, বাংলা-ইংরেজি, কারিগরি-মাদরাসা পর্যায়ে বিভক্তির নানা স্রোত বন্ধ হবে। 

কেন্দ্রীয়ভাবে মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ফলাফল দেয়ার পরিকল্পনা অবশ্যই শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন সংযোজন। একটি আধুনিক, স্মার্ট, মানবিক ও দক্ষ সমাজ গঠন করতে হলে সমাজের সব শিশুকে এক কাতারে নিয়ে আসতে হবে। আর সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকা। প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সময় এখনই।

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যরোধ করা সম্ভব হলে আজকের শিশুরাই আগামী দিনের যেকোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যু, ক্ষতিগ্রস্ত ৪৫ লাখ - dainik shiksha বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যু, ক্ষতিগ্রস্ত ৪৫ লাখ স্কুল-কলেজ ভবন নির্মাণে ৫ শতাংশ কমিশন নিতেন দীপু মনির ভাই টিপু - dainik shiksha স্কুল-কলেজ ভবন নির্মাণে ৫ শতাংশ কমিশন নিতেন দীপু মনির ভাই টিপু বন্যার্তদের জন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তা পাঠাবেন যেভাবে - dainik shiksha বন্যার্তদের জন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তা পাঠাবেন যেভাবে ঢাবি অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজে ভর্তির টাকা জমা দেয়ার সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha ঢাবি অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজে ভর্তির টাকা জমা দেয়ার সময় বৃদ্ধি নতুন শিক্ষাক্রম সংস্কার নয়, বাতিল চাই - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম সংস্কার নয়, বাতিল চাই দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014895915985107