নতুন শিক্ষাক্রম : শিশু শ্রেণি থেকে শুরু হলে আরো ভালো হতো

আসাদুল ইসলাম, জবি |

আমাদের নতুন শিক্ষাক্রম ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এটা অবশ্যই সুন্দর একটি শিক্ষাক্রম যা এক্সপেরিয়েন্স, অ্যাক্টিভিটিস ও পার্টিসিপেশন বেইজড। এই কারিকুলামের টিচিং মেথডও বর্তমান যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একুশ শতকের শিক্ষার্থীর স্কিল বিষয়ে যে কয়টা চাহিদা আছে- লিটারেসি বা লাইফ স্কিলস সবগুলো এখানে সলভ হবে। যেমন একুশ শতকের লিটারেসিতে একটা নতুন স্কিল যোগ হয়েছে, যেটা হলো কনফ্লিক্ট রেজল্যুশন। অর্থাৎ বিবাদ তৈরি, সেটা কিভাবে সমাধান করবে। এটা এক্সপেরিয়েন্সিশাল কারিকুলামের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অ্যাভেইল করা সম্ভব। একটা টিম হিসেবে কাজ করার সময় পারস্পরিক মতভেদ সৃষ্টি হলে কিভাবে সেটা সমাধান করে লক্ষ্যে পৌছাবে সেটা তারা এখানে শিখতে পারবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক সানজিদা আক্তার তান্নি সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে দৈনিক আমাদের বার্তাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। 

নতুন কারিকুলামের মূল্যায়নের পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, এখানে শিক্ষার্থীর কন্টিনিউয়াস মূল্যায়ন চলবে। গাঠনিক মূল্যায়নও চলবে, সাথে সামষ্টিক মূল্যায়নও চলবে। আমরা একেকজন একেকভাবে শিখি, একেকজনের শেখার ধরন একেকরকম। একজন শিক্ষার্থীকে যদি অডিও ও ভিজুয়্যালের মাধ্যমে শেখানো হয় তাহলে হয়তো সে বেশি শিখবে, আবার একজন হতে পারে খুবই শ্রুতিধর আবার কেউ হয়তো আঁকার মাধ্যমে শিখতে পছন্দ করে। নানামুখী ব্লেন্ডেড একটা টিচিং মেথড আমরা নতুন শিক্ষাক্রমে দেখতে পাচ্ছি। আমরা যা শিখি তা আসলে আমাদের সেন্সেস দিয়ে শিখি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা মূল্যবোধের পরিবর্তন এই কারিকুলাম প্রয়োগের মাধ্যমে আনা সম্ভব। 

তিনি আরো বলেন, আমাদের বর্তমান যুগে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের অভাব নেই। আমাদের দেশে এই ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের বিষয়টি খুবই প্রশংসার। কিন্ত আমরা সেখানে দেখি যে রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক নেই। কারণ যাদেরকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে তাদের ওই কাজের জন্য কি কি মোরাল, এথিক্যাল, নর্মস এবং এটিকেট থাকতে হবে তারা সেটা জানে না। যেমন আমার বাসার পাশে খেলার মাঠ, সেখানে দেখা যায় পলিথিন, বোতল এগুলো পড়ে আছে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তো অবশ্যই অথরিটি আছে। কিন্ত আমরা কিভাবে সেটার সাথে আছি, আমাদের ব্যক্তিগত যে পরিবর্তনটা, সেটা কিন্ত হচ্ছে না। আমাদের একটা চিন্তা বা ধারণা আছে, সবকিছুই হয়তো শিক্ষক বুঝিয়ে দেবে। কিন্ত সেখানে আমি নিজে কিভাবে ইনভলভ হবো, নিজে কিভাবে ওই সিস্টেমের সাথে নিজেকে ইনকরপোরেট করব, সেই জায়গাটার সোর্স তৈরি করছে আমাদের নতুন কারিকুলাম। 

নতুন কারিকুলামের মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তৃত অর্থ বাস্তবায়ন সম্ভব উল্লেখ করে সানজিদা আক্তার বলেন, আগে একটা বিষয় ছিলো যে শিখন ঘণ্টা, যেটা বোঝাতো একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে শিখবেন। বর্তমানে আমাদের শিক্ষার যে যুগ এখানে শিক্ষা শুধু বইপত্রে না। শুধু পুথিগত বিদ্যা অর্জনই শিক্ষা নয়, সব জায়গাতেই শিক্ষা রয়েছে। শিক্ষার বিস্তৃত অর্থও কিন্ত সেটাই। সময়ের প্রয়োজনে গান শেখা, ইমোশন ম্যানেজমেন্ট শেখা, রান্না শেখা সবকিছুই শিক্ষা। নতুন কারিকুলাম আমাদের নিশ্চিত করছে যে, শিক্ষার্থীর মধ্যে শিক্ষার বিস্তৃত অর্থটা যেনো অ্যাভেইল হয়।

নতুন এ শিক্ষাক্রমের নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে তান্নি বলেন, আমাদের শেখার জন্য কিছু প্রিরিক্যুইজিট রয়েছে। আমার শিক্ষার্থীরা এটা নিয়ে আগে কতোটুকু পড়েছে, শিক্ষকদের কতটুকু প্রস্ততি আছে এসব বিষয়ে আমাদের ঘাটতি রয়েছে।  এছাড়া সামাজিক একটা বিষয় তো আছে। অনেক মা-বাবা ভাবে যে আমার ছেলে-মেয়ে তো পড়ে না। সারাদিন মোবাইল নিয়ে কি করে আর কি যেনো বানায়, এটা তো পড়া না। তারা ভাবছে যে বাচ্চা তো পড়ছে না, সময় নষ্ট করছে। এই মানসিকতা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গার্ডিয়ানদের আপনি বোঝাতে পারবেন না যে, পরীক্ষা হবে না, কিন্ত আপনার সন্তানের মূল্যায়ন হবে। এটা তারা মানবে না যে, পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়ন সম্ভব। 

শিক্ষকদের দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই কারিকুলামে শিক্ষকদের প্রচুর এনগেজ থাকতে হবে। প্রতিটি ক্লাস নিয়ে তাকে প্রোপার প্ল্যান করতে হবে, প্রত্যেকটা ডকুমেন্ট প্রিজারভ করতে হবে, কনটেন্ট ডেলিভারি করতে হবে, মূল্যায়নের রেকর্ডও রাখতে হবে, পিতা-মাতার সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে, শিক্ষার্থীর অ্যাসেসমেন্টের উপর তার নিজের কোনো হাইপোথিসিস থাকলে সেটা বলতে হবে এবং গার্ডিয়ানকে পরামর্শও দিতে হচ্ছে। তাদের আবার পর্যাপ্ত ট্রেনিং নিতে হচ্ছে, এক্ষেত্রেও অনেক ল্যাকিংস আছে। তাদের আরো বেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং বেশি বেশি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। 

তিনি আরো বলেন, ফিনল্যান্ডের সিস্টেমে রয়েছে একটা ক্লাস পর শিক্ষার্থীদেরকে বিরতি দিতে হবে। তারা যেনো রিক্রিয়েশন বা ফ্রি-প্লে করতে পারেস। আমাদের কি সেটা হয় সম্ভব! এখানে আমাদের একটা বড় ধরনের গ্যাপ হলো আমরা সবকিছু একসাথে ডিজাইন করতে পারিনি। এটা যদি শিশু শ্রেণি থেকে শুরু হতো তাহলে আমার মনে হয় আরো ভালো হত। এমনকি শুরু করলাম পলিসি চেঞ্জ দিয়ে, তারপর শিক্ষকদের ট্রেইনডআপ করলাম। এরপর বাবা-মা, তারপর শিক্ষার্থীর কাছে গেলাম। এরমধ্যে বই, নথিপত্র যা যা দরকার সেগুলো প্রস্তত করলাম। তাহলে বিষয়টি আরো ভালো হতে পারতো।  

শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিজের শঙ্কার কথা জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, আমি বলছি যে প্রজেক্ট বেইজড টিম ওয়ার্ক নেবো, কিন্ত আমার ক্লাসরুম ছোটো। অনেক ক্লাসরুম আছে যেখানে মুভ করার মতো জায়গা নেই। তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদেরকে কিভাবে প্রকাশ করবে? একটা ক্লাসের ব্যাপ্তি কতোটুকু হবে সেটাও একটা বিষয়। ক্লাসে যদি ত্রিশ জন শিক্ষার্থী থাকেন তাহলে সেটা একটা কথা, কিন্ত ক্লাসে শিক্ষার্থী থাকেন পঞ্চাশ বা একশ জন। ক্লাসের টাইমও কম। এতো অল্পসময়ে কিভাবে তিনি এতোগুলো শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করবেন।  

নতুন শিক্ষাক্রমে বিদ্যালয়গুলোকে পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখার গুরুত্ব উল্লেখ করে তান্নি বলেন, বিদ্যালয়গুলো মনিটরিং এবং সুপারভিশনে আরো বাড়ানো দরকার। এটা করা না গেলে সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যাবে। এখনকার বাবা-মায়ের কাছে বাচ্চাদের  দেয়ার জন্য সময় কম থাকে, আমরা যেটা পেয়েছি। এজন্য এখনকার বাচ্চাদের মধ্যে দেখবেন মোরাল, এটিকেট বা নর্ম সেন্স কম। ওদের কিভাবে শেখানো হবে? এক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব যে, মানব শিশুকে একটা মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আইনের মারপ্যাঁচে অনিশ্চিত ১৯তম শিক্ষক নিবন্ধন - dainik shiksha আইনের মারপ্যাঁচে অনিশ্চিত ১৯তম শিক্ষক নিবন্ধন ‘ঢাবির ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হচ্ছে শিগগিরই’ - dainik shiksha ‘ঢাবির ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু হচ্ছে শিগগিরই’ হাই-টেক পার্কের নাম হবে জেলার নামে: উপদেষ্টা নাহিদ - dainik shiksha হাই-টেক পার্কের নাম হবে জেলার নামে: উপদেষ্টা নাহিদ দীপু মনির নামে আরেক মামলা, আসামি ৬০০ - dainik shiksha দীপু মনির নামে আরেক মামলা, আসামি ৬০০ স্কুল-কলেজে বিশৃঙ্খলা : কোথাও জবরদস্তি কোথাও পালিয়ে থাকা - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বিশৃঙ্খলা : কোথাও জবরদস্তি কোথাও পালিয়ে থাকা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024511814117432