নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ইউসুফ আবদুল্লাহ ও তার সহযোগীদের গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে ইনকিলাব মঞ্চ। তার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ীতে ছাত্র হত্যাসহ পঞ্চাশের অধিক মামলা রয়েছে। তার অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার দায়িত্বে কাজ করছেন সিএসই বিভাগের প্রধান রায়হানুল মাসউদ। মাসুদ বুয়েটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবৈধ ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ভূমিখেকো ইউসুফ আবদুল্লাহর ডান হাত হিসেবে পরিচিত রায়হানুল মাসউদ। এর আগে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) সাবেক পরিচালক ও নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলদার হিসেবে চিহ্নিত আবু ইউসুফ আবদুল্লাহসহ আটজনের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।
গত ১৭ অক্টোবর ঢাকার মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মো: শরীফুর রহমান রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে তাদের বিদেশযাত্রায় এ নিষেধাজ্ঞা দেন। যাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তারা হলেন- প্রাসাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ, সাদ আল জাবির আবদুল্লাহ, লাবিবা আবদুল্লাহ, কমোডর এম মনিরুল ইসলাম, শেখ মাহবুবুর রহমান, ওমর ফারুক সবুজ, সাইফুল ইসলাম সেলিম মুন্সি ও রিয়াজুল আলম।
সোমবার সর্বশেষ বিক্ষোভ হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন কোর্ট প্রাঙ্গণে। চলা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ‘সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘স্বৈরাচারের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না’, বিচার চাই বিচার চাই’, ‘জবাব চাই জবাব চাই, দিতে হবে দিতে হবে’ ইত্যাদি সে্লাগান দেন।
ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দোসরদের অন্যতম একজন ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। গত জুলাই থেকে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সে আন্দোলনে হামলার প্রত্যক্ষ নির্দেশদাতা তিনি। আন্দোলনে হামলার জন্য ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছেন আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ।
আরো পড়ুন: জমি জালিয়াতির অভিযোগ নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর পরিচালক থাকাকালে আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ দিনের পর দিন আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে গেছেন। দুর্নীতি করার জন্য তিনি কখনোই ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করতেন না। তিনি দু’টি ইউনিভার্সিটি দখল করে নিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবু ইউসুফ আবদুল্লাহকে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে যে, জবর-দখল করে বেসরকারি নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) চেয়ারম্যান হন আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠাকালীন বোর্ড কব্জায় নিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গড়েছেন নতুন ট্রাস্টি বোর্ড। এর আগে, জমি রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত একটি অভিযোগ এনে ড. আবু ইউসুফ মো: আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে গত ১০ জানুয়ারি মামলা করে আশিয়ান ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক। ওই মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন আবু ইউসুফ।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনসহ সরকার ও বিএমডিসির অনুমতি ছাড়া পরপর দু’টি শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ভর্তির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে অর্থ আদায় করে ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং ডাক্তার, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ না করে অর্থ আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে বনানী থানায় নর্দার্ন ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ের করা এক মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র সাবেক পরিচালক ও প্রাসাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ আবদুল্লাহর ওপর বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের নির্দেশ দেন ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট।
এর পরে ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর জামিনের প্রার্থনাও খারিজ করে দেন। আদালতের আদেশে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলায় ৯১ জন ভিকটিমকে নর্দার্ন মেডিক্যাল কলেজে বিএমডিসির অনুমতি ছাড়া ভর্তি করে টাকা-পয়সা গ্রহণ করেন এবং ওই বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। তারা সব আসামির জামিন বাতিল চান। অপর দিকে আসামিপক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী কমোডর এম মনিরুল ইসলাম ও লাবিবা আবদুল্লাহর যে কোনো শর্তে জামিনের প্রার্থনা করেন।
আদালত উল্লেখ করেন, আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১৪৩/৪০৬/৪২০/১৫৪/ ৫০৬ ধারার অভিযোগে এই মামলা দায়ের হয়। অভিযোগের ধরন ও প্রকৃতি বিবেচনায় এনে আদালত কমোডর এম মনিরুল ইসলামের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। মহিলা ও অভিযোগের ধরন বিবেচনায় আদালত অপর আসামি লাবিবা আবদুল্লাহর জামিন পুলিশ রিপোর্ট দাখিল পর্যন্ত জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন।
আদালতের আদেশে বলা হয়, ১ নম্বর আসামি আবু ইউসুফ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মূল অভিযুক্ত হওয়ায় এবং তিনি নর্দার্ন মেডিক্যাল কলেজের চেয়ারম্যান হিসেবে বেআইনিভাবে অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে মেডিক্যালে ভর্তি করিয়ে এদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়ায় তার জামিন বাতিল করা হলো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করে নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। মো: আবু বকর সিদ্দিকের নেতৃত্বে অধ্যাপক ড. শামসুল হক, লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিনসহ সাতজন তরুণ উদ্যোক্তা এই প্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে আইবিএটি ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্থাপন ও পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে। নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি ২০১১ সাল পর্যন্ত সুনামের সাথে মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষা অর্জনের একটি আস্থার স্থানে পরিণত হয়।
প্রতিষ্ঠানটি যখন বেশ খ্যাতি লাভ করে তখনই অধ্যাপক ড. শামসুল হক (সভাপতি আইবিএটি ট্রাস্ট) তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও পরবর্তীতে সহকর্মী অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ আবদুল্লাহকে এনে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য করার প্রস্তাব করেন। এর পর অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো: আবদুল্লাহ ও অধ্যাপক ড. শামসুল হকের চক্রান্তমূলক যৌথ সিদ্ধান্তে বাতিল করা হয় শুরুর দিকের বোর্ডটি। পরে এনইউবি নামে নতুন ট্রাস্ট গঠন করে দু’জন মিলে গড়ে তোলেন নতুন বোর্ড। ৯ সদস্যের এ বোর্ডের স্থান পান আবু ইউসুফ মো: আবদুল্লাহর পরিবারের সাত সদস্য।
জানা গেছে, কোনো ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করেই প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের বোর্ড থেকে বাদ দেয়া হয়। অধ্যাপক আবু ইউসুফ নিজের পারিবারিক বোর্ড বানিয়ে গড়ে তোলেন একক আধিপত্য। এক যুগেরও বেশি সময় আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলের পথ সুগম করে দিয়েছিলেন শিক্ষালয়টির প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের একজন অধ্যাপক ড. শামসুল হক। ২০১১ সালে অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মো: আবদুল্লাহ ট্রাস্টটি দখল করে নিজের পছন্দসই ৯ জনকে মনোনয়ন দেন। পূর্ববর্তী বোর্ডের একমাত্র সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল হককে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। ড. শামসুল হক বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষপদেও বেশি দিন থাকতে পারেননি। ২০১২-১৩ সালের দিকে তাকেও নীতিনির্ধারণী সব কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে বের করে দেন আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ।
জানা যায় যে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রভাবশালী নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্রভাব খাটিয়ে উদ্যোক্তাদের নানা ভয়ভীতি দেখাতেন আবু ইউসুফ আবদুল্লাহ। কখনো তাদের বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টতা আবার কখনো অবৈধ ক্যাম্পাসে রয়েছে বলে ভয়ভীতি দেখাতেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ২৭ জুলাই প্রতিষ্ঠাকালীন ছয়জন উদ্যোক্তার কাছ থেকে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেন এবং এর সাথে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর ও টিপসই নেয়া হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা ছিলেন সাতজন। এর মধ্যে মো: আবু বকর সিদ্দিক মৃত্যুবরণ করেছেন, অধ্যাপক ড. শামসুল হক বর্তমানে শয্যাশায়ী। বাকি পাঁচজনের মধ্যে আয়েশা আক্তার বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তা ছাড়া বাকি চারজন হলেন- মো: আবু আহমেদ, মো: লুৎফর রহমান, বোরহান উদ্দিন এবং মো: রেজাউল করিম।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দখলকৃত ট্রাস্ট ফেরত পেয়েছেন উদ্যোক্তারা। বোর্ড অব ট্রাস্টিজ অধিকারী হিসেবে উদ্যোক্তারা ফেরত চান প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে তারা মামলাও করেছেন। চিঠি দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে। এ বিষয়ে শিগগিরই বাড়তি আইনগত পদক্ষেপে ৩১ অক্টোবর দখলকারী বর্তমান ট্রাস্টির কাছ থেকে প্রকৃত ট্রাস্টি এবং মূল উদ্যোক্তারা নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি নিজেদের আয়ত্তে ফেরত পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, ফ্যাসিস্ট সরকারের সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনে ইউসুফ আবদুল্লাহ সাতক্ষীরা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তখন দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়।