নিউমার্কেটে সংঘর্ষ : সেই অস্ত্রধারী ঢাকা কলেজের জাকির

নিজস্ব প্রতিবেদক |

চোখে লেগে আছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নৃশংসতার সেই ছবি। নাহিদ মিয়ার নিস্তেজ দেহে পড়ছে একের পর এক ধারালো অস্ত্রের কোপ। কালো হেলমেট ও ধূসর টি-শার্ট পরা ধারালো অস্ত্রধারী কে? অবশেষে মিলল সেই উত্তর। অস্ত্রধারী ঢাকা কলেজের ছাত্র জাকির হোসেন। সে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়।

ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের গত মঙ্গলবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিন নাহিদ মিয়াকে প্রথমে বেদম পিটিয়ে ফুটপাতে ফেলে রাখেন কাইয়ুম। ওই সময়ে তার পরনে নীল-সাদা চেকের টি-শার্ট ছিল। এর পরই হলুদ হেলমেট ও লাল গেঞ্জি পরা এক তরুণ নাহিদকে ইট দিয়ে আঘাত করে। তার নাম সুজন ইসলাম বলে জানা গেছে। দু'জনই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শিক্ষার্থীদের সূত্র সন্দেহভাজন ওই দু'জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে।

সংঘর্ষের মধ্যে লাঠি ও অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করলে একপর্যায়ে ঢাকা কলেজের উল্টোপাশে নুরজাহান মার্কেটের ফুটপাতে পড়ে যান নাহিদ। সেখানে এক যুবক তাকে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। আরেকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে থাকে। একই সময় একজনকে অস্ত্রধারীকে নিবৃত করতে দেখা যায়। দিনদুপুরে ঢাকার সড়কে ওই নৃশংসতার ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে পড়লে মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়, শুরু হয় কঠোর সমালোচনা। ঘটনায় জড়িতদের ছবি প্রকাশ পেলেও তারা কোন পক্ষের, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না এত দিন। শেষ পর্যন্ত অবয়ব ও পোশাক দেখে তিনজনের পরিচয় বেরিয়ে এলো। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, "পুরো সংঘর্ষের সময় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও ব্যবসায়ীদের পক্ষের দিকেও ধারালো অস্ত্র ছিল। এই অস্ত্রধারীদের প্রায় সবার মাথায় ছিল হেলমেট। এ জন্য এদের শনাক্ত করতে সময় লাগছে। তবে ওই তিনজন ছাড়াও 'র', 'ব', এবং 'স' আদ্যাক্ষরের আরও তিনজনসহ মোট ১২ জনকে ছবি দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। এখন প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে ঘটনাস্থলে তারা উপস্থিত ছিলেন কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।"

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্নেষণ করে তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, সংঘর্ষের সময়ে ঢাকা কলেজের হয়ে অতি তৎপর ছিল জসিম, জুলফিকার ও ফিরোজ নামে তিন ছাত্রনেতার অনুসারীরা। জসিম নেত্রকোনার এবং ফিরোজ ও জুলফিকার বরিশাল অঞ্চলের। ক্যাম্পাসে কমিটি না থাকলেও তারা তিনজনই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়।

সন্দেহভাজন তিনজনের পরিচয় পাওয়ার পর ঢাকা কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হিংস্রতার সময়ে ছবি প্রকাশ পাওয়া জাকির, কাইয়ুম ও সুজনও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত। তারা কলেজ হোস্টেলে থাকে। তবে নাহিদের ওপর নৃশংস হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তাদের আর ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নাহিদের ওপর অস্ত্রধারী হামলাকারীকে অনেকে ঢাকা কলেজের ছাত্র ফজলে রাব্বী হিসেবে চিহ্নিত করলেও তদন্তে তাকে ঘটনার সময় সেখানে দেখা যায়নি। তার অবস্থান ছিল ঢাকার বাইরে।

নিউমার্কেটের খাবারের দুই দোকানের কর্মচারীদের দ্বন্দ্বে ঢাকা কলেজের একদল শিক্ষার্থী জড়িয়ে যায়। ওই ঘটনার জেরে গত সোমবার মধ্যরাতে ব্যবসায়ী-দোকানকর্মী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়, যা পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। এতে উভয় পক্ষের শতাধিক আহত হলেও কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ মিয়া ও দোকানকর্মী মোহাম্মদ মুরসালিন নিহত হন। মোশারফ হোসেন নামের ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী এখনও আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া চার মামলার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ধারায় দায়ের হওয়া দুটি মামলা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তদন্ত করছে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, ওই সংঘর্ষের মধ্যে হেলমেট পরিহিত কয়েকজনকে বেশ তৎপর দেখা যায়। তাদের অনেকের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠি। এদের অনেকেই সংঘর্ষের পুরোভাগে ছিল। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ছবি দেখা গেলেও গতকাল শনিবার পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

নাহিদ নিহত হওয়ার পর বলা হচ্ছিল, তিনি পথচারী। এলিফ্যান্ট রোডে নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে প্রাণ হারান। তবে গত দু'দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গেছে, নাহিদ দোকানকর্মীদের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন।

দুটি হত্যা মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা ডিবির রমনা বিভাগের উপকমিশনার এইচ এম আজিমুল হক বলেন, 'সংঘর্ষের সময়ে দুই জনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যায় জড়িতদের শনাক্তে একাধিক দল কাজ করছে। সংঘর্ষে দুই পক্ষের শত শত ব্যক্তি অংশ নেওয়ায় শনাক্ত করতে একটু সময় লাগছে। তবে কোনো নির্দোষ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য কাজটি সতর্কতার সঙ্গে করা হচ্ছে।'

ডিবির তদন্ত-সংশ্নিষ্ট অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ছাড়াও সিসিটিভি ফুটেজ থেকে ছবি নিয়ে দুই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সেই ছবিগুলো দেখানো হয়েছে। অনেকে দেহের গঠন, শরীরের উচ্চতা ও পোশাক দেখে শনাক্তে সহায়তা করছেন। তবে সরাসরি জড়িতদের প্রায় সবাই হেলমেট পরা থাকায় পুরোপুরি শনাক্ত করা যাচ্ছে না।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ছবি দেখালে ধারণা থেকে একেকজন ভিন্ন ভিন্ন নাম বলছেন। তবে তারা সেই নাম নিয়েই প্রযুক্তিগত তদন্ত করে দেখছেন, ঘটনার সময় শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিনা।

অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, তারা ফুটেজ বিশ্নেষণ করে দেখেছেন, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। পাশাপাশি দোকানকর্মীদের হাতেও দেখা গেছে অস্ত্র। এখন নাহিদ ও মুরসালিন ঠিক কোথায় হামলার শিকার হয়েছিলেন, সেই জায়গাটা ঠিকভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এরপর পর্যবেক্ষণ করা হবে, ঘটনাস্থলটি কোন পক্ষের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

বিএনপি নেতা তিন দিনের রিমান্ডে: এদিকে, নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলা মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে গতকাল আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। এর আগে সকালে তাকে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে নেওয়া হয়। পরে শুনানি শেষে আদালত তাকে তিন দিনের রিমান্ড দেন।

মকবুল হোসেন নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনিসহ কয়েকজন সংঘর্ষে উস্কানি দিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছেন। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024900436401367