নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজে লাগামহীন দুর্নীতি

এনামুল হক প্রিন্স |

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সাবেক অধ্যক্ষ, বর্তমান উপাধ্যক্ষসহ ৪৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ নানা দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্ত প্রতিবেদনে। তাতে অবৈধভাবে দেয়া নিয়োগ বাতিল ও সরকারের কোষাগারে টাকা ফেরত নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। 

ডিআইএ পরিদর্শক এনামুল হকের নেতৃত্বে একটি কমিটি এই তদন্তকাজ সম্পন্ন করে।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উপাধ্যক্ষ এ বি এম বেলাল হোসেন ভূঁঞা অবৈধ পদবি ব্যবহার করে অতিরিক্ত চার কোটি পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৭ টাকা উত্তোলন করেছেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে সহকারী অধ্যাপক থাকাকালে তিনি অবৈধভাবে উপাধ্যক্ষ-২ পদে যোগদান করেন। অথচ জনবল কাঠামো অনুযায়ী, এক শিফটের ডিগ্রি কলেজে একজন উপাধ্যক্ষের পদ রয়েছে। এ ছাড়া একজন শিক্ষক একাধিক আর্থিক লাভজনক পদে থাকতে পারবেন না। কিন্তু বেলাল হোসেন উপাধ্যক্ষ-২ পদে যোগদানের পর সহকারী অধ্যাপকের পদ থেকে তার অব্যাহতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উপাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হয়েছেন। ২০১০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত অবৈধভাবে উপাধ্যক্ষ-২ পদের বিপরীতে তিনি এমপিওসহ বেতন-ভাতার তিন কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮২ টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে তুলেছেন। বাসাভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বাবদ প্রাপ্য অর্থের চেয়ে অতিরিক্ত ১৭ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৫ টাকা তুলে নিয়েছেন।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাবেক অধ্যক্ষ মো. রুহুল আমিন গ্র্যাচুইটির নামে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া মামলার ব্যয় দেখিয়ে অবৈধভাবে তুলেছেন চার লাখ টাকা। অধ্যক্ষ পদে বহাল থাকার জন্য ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো চাকরির মেয়াদ পুনর্বৃদ্ধি করেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিপন্থি হওয়ায় এই নিয়োগ বাতিলের আদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে তা পরিচালনায় অবৈধভাবে টাকা উত্তোলন করেন মো. রুহুল আমিন। পরে তিনি মামলায় হেরে যান। অবৈধভাবে পদ ব্যবহার করার সময় তিনি নিয়ম ভেঙে গ্র্যাচুইটির টাকাও আত্মসাৎ করেন।

তদন্তে আরো জানা যায়, নিয়োগ রেগুলেশন টেম্পারিংয়ের (কারসাজি) মাধ্যমে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ আলমগীর। এই নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি অংশের (এমপিও) বেতন-ভাতা আট লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা অনৈতিকভাবে উত্তোলন করেন তিনি। নিয়োগ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী মোহাম্মদ আলমগীরকে অনৈতিকভাবে নিয়োগ দেন সাবেক অধ্যক্ষ রুহুল আমিন। 

তদন্ত প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ প্রদত্ত শিক্ষক নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক হলেও এই সনদ ছাড়াই ১০ জন প্রভাষককে বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কর্মরত এসব শিক্ষক হলেন- মোহাম্মদ রেজাউল করিম, লুত্ফুন নাহার জলি, ফারিয়াল রহমান, ইয়াসমিন আক্তার, ওমর ফারুক রকি, হালিমা আক্তার, নূর এ জাহান, ফাতেমা পারভীন, সাইফুল ইসলাম ও রেজাউল করিম। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ডিগ্রি স্তরে গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে দুজন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। 

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বিধি অনুসরণ ছাড়াই খণ্ডকালীন ও প্যাটার্ন অতিরিক্ত হিসেবে ২৬ শিক্ষক-কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন- প্রভাষক তাসনিম আফরোজ, জোবায়ের হোসেন, মাহমুদা আক্তার মুনমুন, দিলরুবা আফসানা, সুবক্তগীন আরেফিন, তুহিন হাসান, বাংলা প্রভাষক নুসরাত নওরীন শীলা, কম্পিউটার সায়েন্স প্রভাষক রাবেয়া বেগম ও রাকিব হাসান, রসায়ন প্রভাষক মো. রেদওয়ান আহম্মেদ, যুক্তিবিদ্যা প্রভাষক জাহাঙ্গীর খান, ইসলামের ইতিহাস প্রভাষক ওমর শরীফ সিফাত, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট প্রভাষক নিলুফা ইয়াসমিন ও জয় সরকার, অর্থনীতি প্রভাষক নুসরাত বিনতে নূর, গণিত প্রভাষক হযরত আলী রুমি ও সাইফুল ইসলাম, বিবিএ প্রফেশনাল প্রভাষক মো. দানিয়াল ও শামীমা ইয়াসমিন। 

অন্যান্য পদের মধ্যে ইমাম জাহিদুল ইসলাম, অফিস সহকারী গীতিয়ারা সাদিয়া আহসান, ইয়াসিন হৃদয় ও দেলোয়ার হোসেন, লাইব্রেরিয়ান সুপারভাইজার সঞ্জুময় চাকমা, ইলেকট্রিক্যাল পদে জাকির হোসেন এবং চালক পদে আমজাদ হোসেন অবৈধভাবে নিয়োগ পান। 

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে দুজন শিক্ষক জাল সনদের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন। কর্মরত এসব শিক্ষকের মধ্যে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে কম্পিউটার সনদ দিয়ে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে কম্পিউটার প্রভাষক পদে যোগদান করেন তুষার কণা পোদ্দার। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে এমপিওভুক্ত হন তিনি। তদন্তে দেখা যায়, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে কম্পিউটার সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটির নাম উল্লেখ নেই। তিনি অনৈতিকভাবে এমপিও অংশের ১১ লাখ ৬২ হাজার ৮০০ টাকা উত্তোলন করেছেন। এ ছাড়া পরিসংখ্যান বিভাগের প্রভাষক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের দেয়া এনটিআরসিএর নিবন্ধন সনদ যাচাই করে দেখা যায় সেটা জাল। অন্যদিকে যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে রাশিদা সুলতানাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 

এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অধ্যক্ষ মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, যেসব দুর্নীতির কথা সামনে এসেছে, সেগুলো আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে ঘটেছে। আগের কারো অনিয়মের দায় আমি নেবো না।

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল   SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025439262390137