নিপীড়কদের দুঃসাহসের উৎস কোথায়?

ফরিদুর রহমান |

১৪৩১ সালের ২৯ মে প্রকাশ্য রাজপথে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে জোয়ান অব আর্ককে যখন পুড়িয়ে মারা হয় তখন তার বয়স ১৯ বছর। আদালতে জোয়ানের বিরুদ্ধে ৭০টি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধানতম ছিল পুরুষের মতো পোশাক পরিধান, কথিত জাদুবিদ্যা চর্চা ও প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণ। আদালত একাধিকবার তাকে ক্ষমা প্রার্থনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন; কিন্তু প্রতিবারই সে দৃঢ়তার সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রকৃতপক্ষে জোয়ান অব আর্কের প্রতিবাদী চরিত্রই যাজক সম্প্রদায়ের কাছে তার অস্তিত্ব অসহনীয় করে তুলেছিল। ফলে উইঞ্চেস্টারের বিশপ হেনরি বিউফোর্ট তাকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিতে দেরি করেননি।

মধ্যযুগের আইন-আদালত এবং শাসনব্যবস্থার পুরোটাই ছিল ধর্মান্ধ চার্চের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু আজ প্রায় ৬০০ বছর পরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে একজন প্রতিবাদী কিশোরীকে রাজপথে না হোক, প্রকাশ্যে দিনের বেলা তারই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাদে পুড়িয়ে মারার দুঃসাহস দেখায়, তারা কারা? গত ৭০০ বছরে কি এতটুকু এগোয়নি এই দেশ, এই জাতি? নুসরাত তো পুরুষের পোশাক পরে কোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়নি। সে তো প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করে কোনো মতবাদ প্রচার করেনি। সে শুধু একজন ধর্ষকের অশুভ অভিলাষ চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিল এবং সোচ্চার কণ্ঠে জানান দিয়েছিল ধর্ষক-নিপীড়কের বিরুদ্ধে নীরবতার অর্থ ধর্মের লেবাসধারী নারীলিপ্সুদের প্রশ্রয় দেওয়ারই নামান্তর। মৃত্যুপথযাত্রী এই কিশোরীর ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ এবং নিজের হাতে লেখা চিরকুট থেকেই অনুমান করা যায় আপসকামী সমাজের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী অবস্থান। নুসরাতের এই প্রতিবাদী চরিত্রের কারণেই তার কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে শুরু থেকে তৎপর ছিল ধর্ষক ও তার সহযোগীরা। 

একদিকে গ্রেফতারকৃত অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা সোনাগাজী মাদরাসার বিপুল অর্থবিত্ত ও সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন। অন্যদিকে আমাদের দেশের পুলিশ প্রায় সব ক্ষেত্রেই যেমন নির্যাতিতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়, এ ক্ষেত্রেও তার খুব একটা ব্যত্যয় ঘটায়নি। প্রধান আসামি গ্রেপ্তার হলেও শুরুতেই এজাহার পরিবর্তনের মাধ্যমে মামলার গুরুত্ব হ্রাসের প্রচেষ্টার মধ্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহারের মতো সর্বজনবিদিত ‘আইওয়াশ’ও যথানিয়মেই ঘটেছে। এর পরে যদি ধর্ষক সিরাজ ও তাঁর সহযোগীরা বেকসুর খালাস পেয়ে ফুলের মালা গলায় দিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। 

আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাঁর মানবিক অবস্থান থেকে অগ্নিদগ্ধ মেয়েটির শারীরিক অবস্থার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে ধর্ষকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে যারা সমবেত হয়েছে তারা কারা? তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? তারা কি নিতান্তই মাদরাসার তালিব-ইলিম, নাকি এর পেছনে রয়েছে ধর্ষক মাওলানা সিরাজ উদ দৌলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উচ্ছিষ্টভোগীর দল? যেখানে সারা দেশের সচেতন মানুষ এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেখানে সোনাগাজীর পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় তদন্ত চলতে থাকা একটি মামলার আসামির মুক্তির দাবিতে মিছিল ও জনসমাবেশে প্রশাসনের নির্লিপ্ততাকে মাদরাসার বিপুল অর্থবিত্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেই মনে হয়। আমাদের পুলিশ ও প্রশাসনকে কারণে-অকারণে ন্যায্য দাবিদাওয়া সংবলিত অনেক মিটিং-মিছিল পণ্ড করে দিতে দেখা যায়, অথচ একজন চিহ্নিত ধর্ষককে বাঁচানোর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রশাসনের এই নীরবতা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।

সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে ১৭৮০ সালে ব্রিটিশদের আগ্রহ ও অনুগ্রহে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা শিক্ষার বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠ্যসূচি, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা সম্পর্কিত রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কেও। বিগত তিন মাসের পত্রপত্রিকার সংবাদে তাকালে সহজেই চোখে পড়ে এই সময়ে সংঘটিত হত্যা, বলাৎকার, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ এবং ধর্ষণচেষ্টার বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে মাদরাসায় অথবা মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের দ্বারা। বিষয়টি সম্পর্কে যাঁরা পুরোপুরি ওয়াকিফহাল সেসব আলেম-উলামা বা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত বিজ্ঞজনদের কেউ কি বিষয়টি ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেছেন? যদি প্রকৃত বিদ্যোৎসাহী ও মাদরাসা শিক্ষা সংস্কারে আগ্রহী আলেমরা এ ব্যাপারে আলোকপাত না করেন, তাহলে বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারকে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে। প্রতিটি মাদরাসায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের কমিটির তদারকি ও নজরদারির দাবি এখন আর অপ্রাসঙ্গিক নয়। সারা দেশ যখন নুসরাতের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব তখন কোনো মাদরাসা, মক্তব বা আলেমসমাজের পক্ষ থেকে হত্যাকারী বা ধর্ষক ও তার সহযোগীদের শাস্তি দাবি তো দূরে থাক, সামান্যতম প্রতিবাদ, দুঃখ বা শোক প্রকাশের কথাও শোনা যায়নি। 

নুসরাতের সহপাঠীরা যখন আপাদমস্তক বোরকায় আবৃত হয়ে সামনে নুসরাতের জন্য নির্ধারিত একটি আসন শূন্য রেখে পরীক্ষার্থীর আসনে বসে প্রশ্নের উত্তর লেখায় ব্যস্ত তখন বিভিন্ন শহরে, নগরে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য বেদনাহত মানুষ অখ্যাত মাদরাসার মায়াবী মুখের এই কন্যার জন্য, এই বোনের জন্য শোক ও মর্মবেদনা প্রকাশ করে চলেছে। ঘৃণা ও নিন্দায় সারা দেশ যখন মুখরিত তখন মাদরাসাগুলোর নীরবতা এই শিক্ষার অমানবিক অন্তঃসারশূন্যতা নতুন করে সামনে উপস্থিত করে। আমাদের নানা মতের জগাখিচুড়ি শিক্ষা ব্যবস্থার এই দুর্বলতা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব না হলে শিক্ষাঙ্গনে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমরা যদি আগের সব হত্যা ও ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করতে পারতাম, তাহলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হতো।  

‘নুসরাত মরে গিয়ে বেঁচে গেছে’ বলে যারা আহাজারি করছে অথবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, মরে বেঁচে যাওয়া মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয় এবং এটি কোনো সমাধানও নয়। মেয়েটি নিজেও মরতে চায়নি, সে বেঁচে থেকে লড়াই করতে চেয়েছিল। বেঁচে যাওয়া মানুষেরা সতর্ক না হলে, প্রতিবাদে সোচ্চার না হলে ধর্ষক-নিপীড়ক-হত্যাকারীরা বেরিয়ে পড়বে আইনের ফাঁকফোকর গলে। কাজেই সমাজ, সংস্কৃতি ও আইন উপেক্ষা করে ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়ানো সবার ক্ষমতার উৎস খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। হাজার বছর ধরেই যাজক, পুরোহিত ও মোল্লাতন্ত্র নারীবিদ্বেষী এবং সমাজ প্রগতি ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার বিপক্ষে, সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না।    

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক (অনুষ্ঠান), বাংলাদেশ টেলিভিশন

সূত্র: কালের কণ্ঠ

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026249885559082