নির্মোহ দৃষ্টির শিক্ষক নিয়োগ কাম্য

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

এবারের অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে শিক্ষা খাতে অধিকতর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রয়োজনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। এ ব্যবস্থার মধ্যে থাকবে সত্যিকারের শিক্ষক নিয়োগ। বিলুপ্তপ্রায় হারিকেন নিয়েও যথাযোগ্য শিক্ষক পাওয়া না গেলে একসময়ে জাপান যেমন শিক্ষক আমদানি করতে বাধ্য হয়েছিল, তেমনি শিক্ষক আমদানি করা হবে। যথার্থ শিক্ষকের সংকট কী পরিমাণ ঘনীভূত হলে এমন ভয়াবহ ব্যবস্থার কথা উচ্চারণ করা যায়, তা বোধ হয় বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। শনিবার (২০ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন গোলাম কবির।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ এবং যথার্থ শিক্ষকের দুষ্প্রাপ্যতা সম্পর্কে উনিশ শতকে বিদ্যাসাগর তার পরে রবীন্দ্রনাথ কম বাক্য ব্যয় করেননি। তাতে যে কিছু ফল হয়নি তা নয়, তবে গোষ্ঠীর স্বার্থে দেশভাগ, এরপর ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অভিপ্রায়ে নানা অভিসন্ধির মাঝে শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘গিনিপিগ’ করায় শিক্ষা দুর্বল হতে থাকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তা সঠিক অনুধাবন করে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। লেখাবাহুল্য, এই কমিশন এযাবৎকালের সেরা শিক্ষা কমিশন হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ের ঘাতক সরকার আবার পাকিস্তানি কায়দায় দুরভিসন্ধি চালায় বেচারা নিরীহ শিক্ষা নিয়ে। তার ফলে শিক্ষার এই নিদান কালের অবস্থা। বর্তমানে মেধাবী অর্থমন্ত্রীর বিষয়টি নজরে এসেছে। তাই বাজেট বক্তৃতার পর অনেকে শিক্ষা এবং শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। কোনোটি ফেলনা নয়। তবে আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুর মানবমুক্তির চেতনায় বিশ্বস্ত উত্তরাধিকার সরকার যদি আন্তরিক হয়, তবে সব হতাশা কেটে যাবে। কারণ শিক্ষায় এবার হাল ধরেছেন ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পাস করা, মেধাবীদের অন্যতম জনপ্রতিনিধি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদার মেধাবী শিক্ষার্থী এবারের বাজেট পুরোধার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন মেধাবী শিক্ষামন্ত্রী। সুতরাং শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম এবার নির্মোহ হবে, আমরা সে ভরসা রাখতে পারি। সব মতবাদ ও ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে মানবসমাজের উন্নয়ন এবং বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক বিশ্বাস মানবমুক্তিকে প্রাধান্য দিতে পারলে বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানির প্রয়োজন পড়বে বলে মনে করা যাবে না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে একদা শিক্ষায় বাঙালির গুরুত্ব কম ছিল না। শাসকদের শোষণলিপ্সা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষা রসাতলে যেতে শুরু করে। সেই ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘পথের সঞ্চয়’ গ্রন্থে আশঙ্কা করেছিলেন : ‘যে মানুষের মুদির দোকান খোলা উচিত ছিল সে ইস্কুল মাস্টারি করে।’ সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি বলে আমাদের এই নাজুক অবস্থা। জাতি সেই হতাশা কাটিয়ে উঠবে, দুরাশার অন্ধকার দূরীভূত হবে, সেই বিশ্বাস সামনে রেখে আজকের এই লেখার আয়োজন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে সরকার প্রায় পৌনে দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগ দেবে মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে। আগেকার দিনের মতো রাজনৈতিক অভিসন্ধি সামনে রেখে শিক্ষক নিয়োগে তৎপর হলে অন্ধকার কাটবে না। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, যে দল ক্ষমতায় আসীন হয়, তাদের ভুয়া সমর্থকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। এই ভুয়াদের পুনর্বাসনের জন্য বেচারা শিক্ষা বিভাগকে বেছে নেওয়া হয়। বিশ্বাস রাখতে দোষ নেই, তার পুনরাবৃত্তি এবার না হওয়ার কথা।

নানা কিসিমের কোটায় প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম জরাগ্রস্ত। বাংলাদেশের যে বাস্তবতায় শিক্ষা ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি চালু হয়েছিল, তার আর বোধ হয় প্রয়োজন নেই। শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই এখন এগিয়ে। সুতরাং উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা এখন সময়ের দাবি। তা ছাড়া পোষ্য কোটায় উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব দেখা দিলে তা রাখার যৌক্তিকতা বোধ হয় বেশি নেই। অন্য যেসব কোটা আছে, তা আবেগ ও করুণার বিষয়। শিক্ষা ছাড়া সরকারের অনেক ক্ষেত্র আছে, সেখানে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে শিক্ষার অধোগামিতা কিছুটা রক্ষা পায়। মনে রাখা দরকার, কোটা অধিকার নয়, সমবেদনা প্রদর্শন। শিক্ষার বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে এসব অপ্রিয় বক্তব্য রাখার জন্য আমরা দুঃখিত। আবারও বলি আমরা কোটাবিরোধী নই; তবে কোটা দিয়ে শিক্ষাকে কোটাবদ্ধ করতে নারাজ।

মুড়ি-মুড়কির মতো গজিয়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামের সনদ বিক্রির কারখানা থেকে সার্টিফিকেট কেনারা যেন পার পেয়ে না যান, সেদিকে নজরদারি জরুরি, বিশেষ করে শিক্ষকতা ক্ষেত্রে। কারণ দুর্বল সনদধারীরা শিক্ষকতায় আশ্রয় নিয়ে শিক্ষাকে নড়বড়ে করে ফেলেছে। দেশের মেধাবী ব্যক্তিরা শিক্ষাব্রতে নিয়োজিত না হলে শিক্ষার মরণদশা ঘুচবে না।

নিকট অতীতে দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা কায়দায় সনদ সংগ্রহকারীদের ভিড় ভয়াবহ ছিল। কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে না পেরে কয়েকজন বেকার মিলে স্কুল-কলেজ খুলে বসতেন। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চাঁদা তুলে উেকাচ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনও মিলত। এখনো তার প্রবাহ বন্ধ হয়নি। হায়, যারা নিজেরাই অশিক্ষার অন্ধকারে, তারা কী শিক্ষা দেবে! এরা দলীয় সরকারের স্মরণীয় ব্যক্তিদের নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করে। ক্ষমতার হাতবদল হলে আগের দিনের দাসত্বের আনুগত্য ভুলে গিয়ে নতুন সরকারের কেউকেটাদের পদলেহনে প্রবৃত্ত হয়। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, মনুষ্যত্বে পূর্ণ দেশপ্রেমিক মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজনে নির্মোহ দৃষ্টিতে শিক্ষক নিয়োগ দিলে বিদেশ থেকে শিক্ষক আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। প্রসংগত, খেয়াল রাখতে হবে নিয়োজিত ব্যক্তি যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী না হয়।

একসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। হয়তো অনেকে লোভনীয় চাকরিতে প্রলুব্ধ হয়ে চলে যেতেন। তবুও যাঁরা অবশিষ্ট থাকতেন, তাঁদের দিয়ে শিক্ষার মানের তেমন ঘাটতি হতো না। দেশভাগের পর বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর যুগের অগ্রবর্তী ঔদার্যের সর্বনাশ ঘটিয়ে লেখাপড়ার পরিবর্তে ওপরে ওঠার খায়েশে লাল-নীল-সাদার নামে লেজুড়বৃত্তিতে মত্ত হয়ে গেল এবং নিজেদের অনুসারীদের কোথাও কোথাও টাকা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া শুরু হলো। উপরন্তু কর্তাব্যক্তিদের ছেলে-মেয়ে-হবু জামাই ইত্যাদির সুলভ কর্মসংস্থানের জন্য নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা বিলুণ্ঠিত হলো। এখানেই শেষ নয়, যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়নি এবং নিয়োগ নীতিমালার সঙ্গে সংগতিহীন, তাদের জন্য নীতিমালা শিথিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে দেওয়া হলো। তার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে তোড়জোড়ের শেষ নেই। এ যেন সোনার পাথর বাটির মতো। এত সব অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তির অন্যতম পথ নির্মোহ দৃষ্টিতে সত্যিকার শিক্ষাব্রতীদের নির্ভেজাল নিয়োগ। আমাদের কাম্য শিক্ষার সর্বত্র নির্মোহ শিক্ষক নিয়োগ।

 লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.013718128204346