পঞ্চম থেকে একাদশ শ্রেণি : ঝরে পড়ল ১৩ লাখ শিক্ষার্থী

নিজস্ব প্রতিবেদক |

student

প্রাথমিক সমাপনী (পিএসসি) ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে ঝরে পড়ল ১৩ লাখেরও অধিক শিক্ষার্থী। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, মেয়েদের জন্যে উপবৃত্তি, ইংরেজি ও গণিতের অতিরিক্ত ক্লাস- এর কোনোকিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এই ঝরে পড়ার হার। বরং দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়াদের লাইন। এর জন্যে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা এবং নিম্নমানের শিক্ষাকে দায়ী করছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। শিক্ষাবিদ এবং সমাজ বিশ্লেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একে উল্লেখ করছেন শিক্ষাব্যবস্থার রূঢ় এক বাস্তবতা বলে।

মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এসএসসি), এসএসসি ভকেশনাল এবং দাখিল সমাপনী পরীক্ষায় এ বছর নিয়মিত এবং অনিয়মিত মিলে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ জন। এদের মধ্য নিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭ জন।

হিসাব অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের এই ব্যাচটি ২০১০ সালে অংশ নিয়েছিল প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় এবং ওই বছর নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৮ জন। দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরের দৌড় শেষে মাধ্যমিক, ভকেশনাল এবং দাখিল সমাপনী পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছাতে এদের মধ্যে থেকে ঝরে পড়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ জন শিক্ষার্থী।

অথচ, শিক্ষার্থীদের এই ঝরে পড়া বন্ধে সরকার অনেক আগে থেকেই বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে, মেয়েদের জন্যে উপবৃত্তি অব্যাহত রেখেছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় দেশের ৬১টি জেলার পিছিয়ে পড়া ১২৫টি উপজেলার ৫৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের গণিত ও ইংরেজি বিষয়ের ভীতি দূর করতে অতিরিক্ত ক্লাস পরিচালনা করা হচ্ছে। এমনকী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া আটকাতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তার আগের মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরপরই শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষার পাশাপাশি অষ্টম শ্রেণিতে যুক্ত করেছে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। কিন্তু এর কোনোকিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া। বরং দীর্ঘ হচ্ছে ঝরে পড়াদের মিছিল।

সরকারের দেওয়া হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০১০ সালের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় মোট নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুপস্থিত এবং অকৃতকার্যের সংখ্যা ছিল চার লাখ ৭২ হাজার ৩৫২ জন। সে হিসেবে ওই বছরে পাস করেছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৯৬৬ জন এবং এদের প্রত্যেকে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করেছে এমনটি ধরে নেওয়া হলেও। ২০১৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় তাদের মধ্যে থেকে অংশ নেয়নি এক লাখ ৫১ হাজার ৫৮৬ জন এবং অকৃতকার্য হয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ, ওই স্তরে পাস করেছিল এমন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ১০৯ জন। যাদের প্রত্যেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ভকেশনাল এবং দাখিল সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিবে এমনটি ধরে নেওয়া হলেও ওই স্তরে এসে তাদের সংখ্যা ঠেকেছে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৭ জনে। অর্থাৎ, আবারো ঝরে পড়ল দুই লাখ ১৮২ জন।

এদিকে মাধ্যমিক ও সমমানের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় নিয়মিত এ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে অকৃতকার্য হয়েছে এক লাখ ৪৬ হাজার ৯২১ জন এবং উত্তীর্ণ হয়েও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্যে আবেদন করেনি এমন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এক লাখ ৫৪ হাজার ৩৬৬ জন। অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে সব মিলিয়ে ঝরে পড়ল ১৩ লাখ ১২ হাজার ৬৩৮ জন শিক্ষার্থী।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত দুর্বলতাকে দায়ী করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার কারণ আলাদা। মাধ্যমিকের পরের স্তরে ঝরে পড়ার কারণ আরো আলাদ। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা প্রাক-প্রাথমিকের মধ্যে দিয়ে না আসার কারণে তাদের অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলে, আনন্দটা পেয়ে ওঠে না। তাই প্রাথমিকেই অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। অপরদিকে মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার মূল কারণ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ মেয়ে। যারা বাল্যবিবাহ এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ছে। আর ছেলেরা যোগ দিচ্ছে কাজে। কারণ পড়ালেখার চেয়ে কোনো কর্মে যোগ দেওয়াটাই তাদের কাছে লাভজনক বলে মনে হচ্ছে।

এ ছাড়া শহর ও নগরের বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেও শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে বলে মনে করছেন রাশেদা কে চৌধুরী। তাই ঝরে পড়া আটকাতে হলে গতানুগতিক চিন্তা দিয়ে নয় বরং সরকারকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে এবং শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন তিনি।

তিনি বলেন, যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপি’র চার শতাংশ বিনিয়োগ থাকা উচিত সেখানে বর্তমানে রয়েছে মাত্র দুই দশমিক দুই শতাংশ। শিক্ষার্থীদের সংখ্যার অনুপাতে তা অপ্রতুল বলেই মনে করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।

তিনি আরো বলেন, দেশের সকল শিক্ষার্থীকে সাধারণ শিক্ষায় অংশ নিতে হবে এমন ভাবনাটাও বাস্তবসম্মত নয়। তাই প্রতিটি স্তরে ফাঁকে ফাঁকে দরকার কারিগরি শিক্ষাসহ বিকল্প নানা সুযোগ। কিন্তু সেই বিকল্প সুযোগও আমরা দিতে পারছি না। ফলে যারা ঝরে পড়ছে ধরে নিতে হবে তারা পুরোপুরিই শিক্ষা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আর শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলেন, শিক্ষা সুযোগ এখন আর বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, বেতন মওকুফ এবং উপবৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। শিক্ষা উপকরণ থেকে শুরু করে প্রাইভেট কোচিং, গাইড বই সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা এখন বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। অনেকের পক্ষেই যা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে অজ্ঞতা বা বোধের অভাব। তা ছাড়া বোধটা তৈরি করাও সম্ভব হয়নি। কারণ লেখাপড়ার সঙ্গে জীবিকারও সম্পর্ক নেই। লেখাপড়া দিয়ে বেকারত্ব দূর হবে এমনটিও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফলে সমস্যাটাই অর্থনৈতিক। কিন্তু এই সমস্যার মূলে যেতে চাচ্ছে না সরকার। এতগুলো শিক্ষার্থী কোথায় হারিয়ে গেল? কেন হারিয়ে গেল তাও বুঝতে চাচ্ছে না। বরং সরকার হইহুল্লোড় করছে জিপিএ ৫ নিয়ে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনীতে পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৯২ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ৮৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চার শতাংশ বেশি। একই ভাবে ২০১৩ সালের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল যথাক্রমে ৮৯ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৯১ দশমিক ১১ শতাংশ। বলা হয়েছিল ওই বছরে পাসের হার, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এবং শতভাগ পাস করা স্কুলের সংখ্যায় অর্থাৎ তিনটি সূচকেই আগের বছরের তুলনায় বেশি ছিল!


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037479400634766