পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে বেদম প্রহার প্রধান শিক্ষকের

দৈনিক শিক্ষাডটকম, নরসিংদী |

নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার ৮৬নং আকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ আফ্রাদের বিরুদ্ধে গ্রামবাসী নানা অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি তুচ্ছ ঘটনায় ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটানোর পর গ্রামের অনেকেই এখন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন।

সরেজমিনে উপজেলার আকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে কথা হয় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার স্বজনদের সঙ্গে। স্থানীয় অনেকেই বলছেন, শুধুমাত্র কলম চাওয়াকে কেন্দ্র করে পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর ওপর এমন নির্যাতন কেউ করতে পারে না। এই বাচ্চাটার শরীরের ক্ষতচিহ্নই প্রমাণ করে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকেই এমন নির্যাতন চালিয়েছেন প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ আফ্রাদ।

 

আহত শিক্ষার্থী জানায়, গত ১৮ জুলাই আমি স্কুলে যাওয়ার পর স্যার (প্রধান শিক্ষক সফিউল্লাহ আফ্রাদ) আমাকে উনার কাছে প্রাইভেট পড়তে বলেন। তখন আমি বাড়িতেই প্রাইভেট পড়ি বলে সেখান থেকে ক্লাসে চলে আসি। পরে দুপুরে সফিউল্লাহ স্যারের গণিত ক্লাস চলাকালীলে আমার কলমের কালি শেষ হয়ে যাওয়ায় আমি আমার পেছনে থাকা সহপাঠীর কাছে কলম চাইতে গেলে স্যার দেখে ফেলেন। তখন স্যার উনার হাতে থাকা একটি বেত দিয়ে আমার ঘাড় নিচু করে পেটাতে থাকেন। সে সময় অনেকগুলো আঘাত দেওয়ার পর সেই বেতটি ভেঙে গেলে স্যার আরেকটি বেত আনিয়ে আমার হাতে, পিঠে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে পেটায়। পরে ক্লাস শেষে আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে এলে আমার বাবা ও চাচারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। 

ওই শিক্ষার্থীর চাচা সোহেল আফ্রাদ জানান, দীর্ঘদিন ধরেই ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার ভাতিজিকে তার কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য বলতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সকালে স্কুলে যাওয়ার পর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ আফ্রাদ তাকে আবারও প্রাইভেট পড়তে বলে। তখন সে (শিক্ষার্থী) তার বাড়িতে প্রাইভেট টিচার রয়েছে জানিয়ে প্রধান শিক্ষকের দেওয়া প্রাইভেটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এতে প্রধান শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে ক্লাস চলাকালে কলম চাওয়াকে ইস্যু করে শিক্ষার্থীকে বেত দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। 

তিনি আরো বলেন, ওই প্রধান শিক্ষক তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হয়রানিসহ মারধর করেন। এতে ভয়ে শিক্ষার্থীরা উনার কাছে প্রাইভেট পড়ে। অতীতেও উনি অনেক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেছে। এমন অনেকে সন্তানদের এই প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে নিয়ে গেছে।

কারিমা বেগম নামে এক শিক্ষার্থীর মা অভিযোগ করে বলেন, ১৫-২০ দিন আগে আমাদের গ্রামের একজনের নাতিকে পিটিয়ে আহত করেন প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ আফ্রাদ। পরে ওই শিক্ষার্থীর দাদা সালেহকে ধরে তার হাতে ৫০০ টাকা ধরিয়ে দেন চিকিৎসার জন্য এবং বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করেন ওই শিক্ষক। এমনিভাবে আমার ছেলেকেও পিটিয়ে আহত করেছেন তিনি। আমার ছেলের পাওয়া উপবৃত্তির টাকা উনার কাছে প্রাইভেট পড়িয়ে কাটিয়ে দিতে হবে। এমন নিয়মে না চললে নম্বর কম দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন হয়রানি করেন। একপর্যায়ে পিটিয়ে আহত করেনন ওই শিক্ষক। 

সুফিয়া বেগম নামে আরেক শিক্ষার্থীর মা জানান, উনি যখন থেকে স্কুলে ঢুকেছেন তখন থেকেই প্রাইভেট পড়াতে থাকেন। আর ছাত্র-ছাত্রীরা উনার কাছে প্রাইভেট না পড়লেই মারধরের পাশাপাশি খাতায় নম্বরও কম দেন। উনার কারণে অনেক শিক্ষার্থী এ প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। আমরা এই প্রধান শিক্ষকের অপসারণ চাই।

শুধু তাই নয়, ছাত্রছাত্রীদের থেকে পরীক্ষার ফি-এর নামে অর্থ আদায়, স্কুলে এক প্রকার জোরপূর্বক প্রাইভেট পড়ানো, রাতেও স্কুলে প্রাইভেট পড়ানো, স্কুলের গাছ কেটে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, স্কুলে সময় মতো উপস্থিত না হওয়া, স্কুল বাউন্ডারির এক পাশে ব্যক্তিগত আক্রোশে দেয়াল নির্মাণসহ আরও নানা অভিযোগ ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তুলে ধরেন গ্রামবাসী।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয় একজন বলেন, প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ আফ্রাদ স্কুলটাকে তার ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করে পরিচালনা করছেন। সামাজিক সুবিধা অসুবিধা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তিনি কাজ করছেন। তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েও কোনো ফায়দা হয় না। শুনেছি তার নিকটতম দুইজন আত্মীয় সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাদের দিয়ে কথা বলিয়ে সবাইকে তিনি শান্ত করিয়ে দেন।

এ ব্যাপারে ৮২নং আকানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ আফ্রাদের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, রাগের মাথায় কিছু চড়-থাপ্পড় দিয়েছিলাম। তবে তাদের বাড়িতে গিয়ে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধান করে এসেছি। এছাড়া আমার এর আগে কখনো কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমনটা হয়নি। এর বাহিরে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা এবং ষড়যন্ত্রমূলক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে।

বিষয়টি নিয়ে মুঠোফোনে কথা হয় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আকরাম হোসেন আফ্রাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুনেছি প্রধান শিক্ষক মারধর করায় এক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়েছে। পরে স্কুলের শিক্ষকসহ সেই শিক্ষার্থীর বাড়িতে গিয়ে তাকে দেখে আসি এবং তার চিকিৎসা বাবদ কিছু টাকাও তার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে আসি। এ রকম এর আগেও কিছু শিক্ষার্থীর সঙ্গে হয়েছে, প্রতিবারই আমরা তাকে সাবধান করি। 

পরীক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় ও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানোর কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, পঞ্চম শ্রেণির একটি পরীক্ষা বাবদ ১০০ টাকা করে নেওয়ার কথা শুনে তাকে জিজ্ঞেসা করেছি। তবে বিষয়টি নিয়ে সময়ের অভাবে আর সামনে এগোতে পারিনি। এছাড়া প্রাইভেট তিনি পড়ান, তবে জোড় করে পড়ান এমনটা শুনিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে মা সমাবেশে আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করে পড়ানোর নির্দেশনা দিই। তবে সকলকেই পড়তে হবে এটা বাধ্যতামূলক নয়। 

স্কুলের প্রাচীর নির্মাণ এবং গাছ কাটার বিষয়ে আকরাম হোসেন আফ্রাদ বলেন, এ সকল কাজ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী হয়েছে। তবে উত্তর-পূর্ব দিকে লোহার র‍্যালিংয়ের পরিবর্তে ১০-১২ ফুট জায়গা ইটের দেয়াল নির্মাণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তখন প্রধান শিক্ষক ও ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনা করলে প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন এদিক দিয়ে গরু-ছাগল বিদ্যালয়ের মাঠে প্রবেশ করে। তাই এ দিকে র‍্যালিংয়ের পরিবর্তে দেয়াল স্থাপন করা হয়েছে। তখন কাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সেটি আর ভাঙা সম্ভব হয়নি। তবে সামনের মিটিংয়ে এলাকার গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে রেখে একটি পকেট গেইট রাখা যায় কি না এ ব্যাপারে আলোচনা করব।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ জুনায়েদ বলেন, এসব বিষয়ে আমাকে এর আগে কেউ কিছু জানায়নি। এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। কেউ অভিযোগ করলে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসিবা খান বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগগুলো দিলে আমরা বিষয়টি দেখব, তদন্ত করব এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030617713928223