সুপার মিজানুর রহমান যে আসলেই সুপার, সে বিষয়ে আপনাদের সন্দেহ থাকতে পারে। আমার নেই। পঞ্চাশ পেরিয়ে একান্নে পা দিয়েছেন, আর এই অর্ধ বৃদ্ধ কিনা বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ১৮ বছরের এক মেয়েকে, যে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার মাহিরুন নেছা দাখিল মাদরাসার ছাত্রী, আর মিজানুর রহমান হচ্ছেন ওই মাদরাসার সুপার-কাম শিক্ষক! মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
দু'জনের মাঝে আরও একটা সম্পর্ক আছে, যদিও তা সাবেক। ওই সুপারের এক ভাতিজার সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল ওই মেয়েটির, অল্পদিনে তা ভেঙেও যায়।
তবে এই ঘটনাকে 'অতিরঞ্জিত' বলেছেন ওই মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাবিবুর রহমান। এটা মেনে নিয়েই আমরা যদি 'অতি'টুকু বাদ দেই, তাহলে 'রঞ্জিত'টুকু কিন্তু রয়ে যায়। তার মানে, যা রটে তা কিছুটা ঘটে। ঘটনা অনেকটা সত্য। একান্ন বছরে ১৮ বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়ে আপনি প্রমাণ করলেন- শিক্ষকরাও মানুষ, অন্য মানুষের মতো কাম-লালসার ঊর্ধ্বে নয় তারা। সুপার, আপনি সত্যি সুপার; সুপার মিজানুর রহমান। দুনিয়ায় এত মেয়ে; আর শিক্ষক হয়ে আপনার কি-না চোখ গেল ভাতিজার সাবেক স্ত্রীর দিকে!
পরীক্ষার ফি দিতে দেরি করেছিল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রাজনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মন্তাজ আলী মেয়েটিকে এই কারণে বেত দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটান। অসুস্থ হয়ে যায় সে। ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। তার বাবা লিখিত অভিযোগ করেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সৌরভ গোস্বামীর কাছে। সরেজমিন তদন্তে ঘটনার সত্যতা পান তিনি। বদলির সিদ্ধান্ত হয় মন্তাজ আলীর।
মন খারাপ করে ফেলেন এজন্য মন্তাজ আলী। গোস্সা হয়ে ওই ছাত্রীকে জরুরি দরকারের কথা বলে অফিস কক্ষে ডেকে নেন তিনি। দরজা বন্ধ করেন তারপর। এ সময় তিনি আর তার ১৫ বছরের ছেলে জাকারিয়া মিলে অর্ধনগ্ন করেন ওই বাচ্চা মেয়েটাকে। ভয়ভীতি দেখিয়ে কয়েকটি ছবি তোলেন তার। ওগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়ারও হুমকি দেন।
প্রধান শিক্ষক মন্তাজ আলী, জনাব, আপনি যখন ওই বাচ্চা মেয়েটাকে অর্ধনগ্ন করেন, তখন আপনি আর আপনার ছেলে কি একই সঙ্গে মেয়েটার দিকে তাকিয়েছিলেন? বাপ-বেটার মতো সম্মান জাগানিয়া সম্পর্কটা তখন কোথায় পালিয়েছিল? আপনি লজ্জা পাননি, একটুও চোখের পাতা কাঁপেনি আপনার? আপনার চেহারাটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মন্তাজ আলী। ওটার আদল এখন ঠিক কেমন দাঁড়িয়েছে, কোন চতুষ্পদের সঙ্গে মিলে গেছে তা এ মুহূর্তে!
রাজবাড়ী শহরতলির শ্রীপুর লজ্জাতুন্নেছা কামিল মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হলেন দিদারুল্লাহ। এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি। এলাকার একটা কলেজপড়ূয়া ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। এই সূত্রে অধ্যক্ষ তাকে মাদ্রাসায় চাকরির প্রলোভন দেন, এমনকি বিয়ের প্রস্তাবও। তার পর কয়দিন আগে ওই ছাত্রীকে ফোনে ডেকে নেন বাসায়। লজ্জাতুন্নেছা কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ দিদারুল্লাহ সব লজ্জা বিসর্জন দিয়ে শ্লীলতাহানি করেন ওই ছাত্রীকে।
আর গাজীপুরের ছয়দানা এলাকার আদর্শ শিশুকানন কিন্ডারগার্টেনের সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন সব আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে অশোভন আচরণ করেন এক শিশুর সঙ্গে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক কক্ষে। সবশেষে মোটাদাগের একটা হুমকিও দেন ওই শিশুকে- কাউকে কিছু না বলার জন্য। বাড়ি ফিরে ছেলেটি কাউকে কিছু বলেনি। কিন্তু রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন পরিবারের সবাই। পরে সব কথা খুলে বলে শিশুটি।
হাত প্রায়ই নিশপিশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুর রশীদের। ২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবারও নিশপিশ করছিল। কিন্তু থাপড়াবেন কাকে- খুঁজে পাচ্ছিলেন না তা। এরই মধ্যে তিনি খেয়াল করলেন- ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের 'রিয়াদুস সালেহীন' বইটি নেয়নি ২০ শিক্ষার্থী। বের হয়ে যেতে বলেন তিনি তাদের ক্লাসরুম থেকে। সবাই বের হতে যাচ্ছিল, তার মধ্যে চার-পাঁচজনের দেরি হচ্ছিল একটু। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাসির নামে এক ছাত্রের কানে থাপ্পড় দেন তিনি। কানের পর্দা ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে যায় তার।
আব্দুর রশীদ স্যারের আরও কিছু অভ্যাস আছে- কারণে-অকারণে খারাপ ব্যবহার করেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে; অপমানজনক কথাও বলেন তাদের। আরও একটা কাজও করেন- মিথ্যা বলেন অবলীলায়। ক্লাসভর্তি সবাই ঘটনাটা দেখল, আর তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন কিনা- এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো, আখতারুজ্জামান বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ভর্তির বিষয়ে তাঁর জানা আছে। সন্ধ্যাকালীন প্রোগ্রাম হওয়ায় ওই ভর্তির প্রক্রিয়াটি জানা নেই তাঁর। অথচ ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য এবং এর জন্য ছাত্রত্ব রক্ষার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক হয়ে যাওয়া ৩৪ জন ছাত্র ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে একটি সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছিলেন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই! তাদের অধিকাংশই ভর্তি হয়েছেন উপাচার্যের চিরকুটে। আর মহামান্য উপাচার্য স্যার বলেন কিনা- ভর্তির প্রক্রিয়াটি জানা নেই তাঁর!
এবং পণ্ডিত নগেন মুন্সী...
পণ্ডিত নগেন মুন্সী স্যার যে সিরাজগঞ্জের জ্ঞানদায়িনী উচ্চ বিদ্যালয়ে ব্যাকরণ পড়াতেন আমাদের, তা তো আপনাদের অনেকবার বলেছি। মাঝে মাঝে তিনি বলতেন, 'সব অন্যায় দূর হয়ে যাবে, যদি মিথ্যা বলা বন্ধ করা যায়।'
হাওয়াই চপ্পল পরে স্কুলে আসতেন স্যার। ক্ষয়ে যাওয়া চপ্পলের ফিতা খুলে যেত অনেক সময়। স্কুলের মাঠে কিংবা লাইব্রেরির সামনে, কখনও ক্লাসে দাঁড়িয়েই তিনি ওটা হাতে নিতেন। ফিতাটা ঠিক করে হাঁটতে শুরু করতেন আবার।
তিন যুগ আগে মারা গেছেন স্যার। তিনি বেঁচে থাকলে তার ওই চপ্পলটা চেয়ে নিতাম। মানুষ আকৃতির কাউকে জড়িয়ে ধরার চেয়ে ওই চপ্পল দুটি জড়িয়ে ধরতাম বুকের সঙ্গে।
চপ্পল দিয়ে আরও একটা কাজ করতাম। কিন্তু কাজটি কী- তা আর এ মুহূর্তে বলতে ইচ্ছে করছে না।
সুমন্ত আসলাম : লেখক ও সাংবাদিক