মহামারি করোনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দেউলিয়াপনা ও অবস্থাপনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শিক্ষায় সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবের বিষয়টি সচেতন যেকোনো নাগরিককে নতুন করে মর্মাহত ও পীড়িত করেছে। যে কোনো দূর্যোগ বা মহামারির একটা পূর্ব প্রস্তুতি থাকে। এবারের বৈশ্বিক মহামারি করোনায় আমাদের শিক্ষায় সে রকম কোনো প্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করা যায়নি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ার পর সেটি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। চীনসহ পৃথিবীর নানা দেশের গবেষকরা, এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বিভিন্নভাবে সতর্ক করেছে। চলতি বছর মার্চ মাসের অর্ধেকটা সময় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন মাস সময় আমরা কেবল হা করে করোনা ধেয়ে আসার সংবাদ শুনেছি। একটা সামান্য ঝড়- বাতাস আসতে দেখলেও মানুষ সচরাচর একটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। আমরা সে রকম কিছুই করিনি। কেবল সাবান দিয়ে বার বার হাত ধোয়া ও মাস্ক পরা নিয়ে কিছুদিন একটু হৈচৈ করেছি।
মানব জীবনে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রধান দু'টি মৌলিক চাহিদা। এবার করোনা মানুষের এই দু'টি চাহিদার ওপর কঠিন আঘাত হেনেছে। মানুষ একটি শরীর বা দেহ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বটে, শিক্ষা তাকে প্রকৃত ও যথার্থ মানুষ করে গড়ে তুলে। শিক্ষার বলে মানুষ পৃথিবীতে সভ্যতার সূত্রপাত করেছে এবং পর্যায়ক্রমে অন্য সব জীবের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এবার করোনা মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রত্যক্ষ এবং শিক্ষার ওপর পরোক্ষ অথচ দীর্ঘমেয়াদী আঘাত হানার কারণে আমার কেন যেন বার বার মনে হয়েছে, পৃথিবী থেকে মানুষের অস্তিত্বে উঠিয়ে দেবার জন্য করোনারূপে কেউ হয়তো উঠেপড়ে লেগেছে। তা না হলে স্বাস্থ্যখাতে প্রত্যক্ষ আঘাত হেনে করোনা মানুষের অস্তিত্বকে যেটুকু হুমকির মুখে ফেলেছে, তারচেয়ে বেশি শিক্ষাখাতে পরোক্ষ আঘাত হেনে মানবসভ্যতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অন্য কোনো জীব এভাবে হয়তো পৃথিবী থেকে মানুষ জাতিকে উঠিয়ে দিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য যেকোনো মূল্যে শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সারা পৃথিবী জুড়ে সেই প্রয়াসটি আগে থেকে প্রতীয়মান হলেও আমাদের ভিন্ন অবস্থা। আমাদের শিক্ষা এক রকম অভিভাবকহীন অবস্থায় একই জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বলেই মনে হয়। স্বাধীনতার পরের বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় অভিভাকত্বের যে দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কালো রাতে সে দায়ভার রাষ্ট্রের কাঁধ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। সেই থেকে এদেশে শিক্ষার পথহীন চলা। সেই গন্তব্যবিহীন চলায় শিক্ষায় আজ নানা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।
আজকের লেখাটির শুরুতে করোনার খবর পাওয়া মাত্র শিক্ষার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এবং তা পুষিয়ে নেবার উপায় বের করে রাখার বিষয়ে আলোকপাত করতে চেয়েছি। ডিসেম্বরে করোনার সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে বিকল্প শিক্ষা দান ও মুল্যায়নের উপায় স্থির করে রাখা উচিত ছিলো। মহামারির কারণে পাবলিক পরীক্ষা নিতে না পারলে অটোপাসের পরিবর্তে অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য উপায় বের করে রাখা যেতো। অটোপাস শিক্ষায় কোনো সাফল্য নয়, বরং কলংক- সে কথাটি মাথায় রেখে অগ্রসর হওয়া যেতো। আমরা শিক্ষা বাঁচাতে অটোপাসের পথ ধরে হেঁটেছি। এ কোনো সঠিক পথ নয়। অনলাইন শিক্ষাদানের বিষয়টি আগে থেকে ঠিক করে রাখা যেতো। অনলাইন শিক্ষাদানের ধারণাটি শিক্ষকরাই সামনে নিয়ে এসেছেন। বেসরকারি শিক্ষকরাই অনলাইন স্কুলে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। বেসরকারি শিক্ষকদের শিক্ষা বিভাগে পরামর্শক কিংবা অন্য কোনো দায়িত্বশীল পদে বসানো হয়না। সে সব জায়গায় বসতে পারলে তারা শিক্ষা ও শিক্ষকের কল্যাণে অনেক কিছু করতে পারতেন।
আমি ঠিক জানি না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কীনা? করোনার কারণে গার্মেন্টস বা কল কারখানা কয়দিন বন্ধ থেকেছে? অফিস, আদালত, হাট বাজার ও গণপরিবহনে কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে? দৈনিন্দিন জীবনে সামাজিক কিংবা শারীরিক দূরত্ব যেটি বলিনা কেন, কতটুকু প্রতিপালিত হচ্ছে? এ জাতীয় প্রশ্নের যথার্থ উত্তর খুঁজে পেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে হলেও খুলে দেবার বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
দেশে করোনা হানা দেবার আগে থেকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়টি ঠিক করে রাখা যেতো। এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা যেতো। শিক্ষার্থীদের ডিভাইস ব্যবহারে পারদর্শী করে তোলা যেতো। পূর্ব থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে নেটওয়ার্ক ফ্রি করে দেয়া যেতো। সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে পাঠদান প্রচার না করে বিটিভিতে প্রচার করে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা যেতো। তারপরও যেসব অনলাইন ক্লাস হয়েছে, সে সবের আলোকে পূর্ব থেকে মুল্যায়নের একটি উপায় বের করে রাখা যেতো। এতো ঢালাওভাবে কোনো মুল্যায়ন ছাড়াই অটোপাস দেয়ার কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যায় না।
এক শ্রেণির শিক্ষার্থী অটোপাসের খবরে আনন্দ উল্লাস করেছে। কিন্তু যারা ভালো করতে চেয়েছে, তারা কান্নাকাটি করেছে। এ কান্না তাদের সারা জীবনের সাথী হয়ে কেবল পীড়া দিতে থাকবে। অনেক পিতামাতার স্বপ্ন আতুঁড় ঘরেই মারা পড়েছে। সন্তানের ভালো ফলে তৃপ্তির হাঁসির সুযোগটি তাদের কপালে জুটেনি। করোনা এভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কপাল পুড়িয়েছে। আমরা আগেভাগে প্রস্তুতি নিলে তাদের কপালটা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা বাঁচানো যেতো। এবারের এইচএসসি পরীক্ষা হবেনা। বার্ষিক পরীক্ষাও নেই। প্রাথমিক সমাপরী ও জেএসসি পরীক্ষা আগেই বাতিল করা হয়েছে। এখন অনলাইন ক্লাস চালিয়ে আর কী হবে ?
সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে 'আমার ঘরে আমার স্কুলের আর কী দরকার ? সারাদেশের অসংখ্য অনলাইন স্কুল এখন চলবে কী চলবে না-সে নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। একটি অনলাইন স্কুলের একজন এডমিন অনলাইন ক্লাস চালাবেন কীনা সে বিষয়ে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন। ৩০ দিনের একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ভিত্তিতে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির নির্দেশনা দেবার পর অনলাইন ক্লাসের কোনো প্রয়োজনীয়তা আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। অনলাইন ক্লাসের আলোকে একটি মুল্যায়ন করা যেতো। তাতে পড়াশুনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অব্যাহত থাকতো এবং অনলাইন ক্লাস দিনে দিনে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠতো।
পৃথিবীর অনেক দেশে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। সেটির আশংকায় আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও খুলে দেবার কোনো উদ্যোগ নেই। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে খুলে দেবার দাবিটি আজ নতুন নয়। যে কোনো বিষয়ে কাউকে না কাউকে ঝুঁকি নিতেই হয়। সমন্বিত ঝুঁকি গ্রহণে কেউ কাউকে দোষারোপ করতে পারে না। সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার ঝুঁকি একা নিতে চাইবে না। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের কাছে দাবি জানালে সরকার সমন্বিত ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারে। এ পথে হেঁটে কওমি মাদরাসাগুলো কয়েক মাস আগেই খুলে গেছে। তাদের শিক্ষা কার্যক্রম এখন যথারীতি আগের মতো চলছে।
'অটোপাস' শিক্ষায় একটি অশুভ মাইল ফলক। এক শ্রেণির শিক্ষার্থী অটোপাসে খুব আগ্রহ ব্যক্ত করছে। কেউ কেউ অটোপাসের দাবিতে ভেতরে ভেতরে সক্রিয় আছে। সামনে ২০২১ খিষ্টাব্দের এসএসসি পরীক্ষা। এর প্রাক্ নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষার সময় ইতিমধ্যে গত হয়েছে। অতি উৎসাহী শ্রেণিটি অটোপাসের আশায় হয়তো বসে আছে। আমরা আর কোনো অটোপাস চাইনা। সময় বাড়িয়ে দিয়ে হলেও পরীক্ষা বা মুল্যায়নের মাধ্যমে সামনের এসএসসিসহ সব পরীক্ষায় পাস দেয়া হোক। পরীক্ষায় অটোপাসের চিন্তা কোনমতে আর কাম্য হতে পারেনা। আর কোনো অটোপাস নয়- এরকম একটি ঘোষণা সরকারিভাবে এখনি জোরেসোরে জানিয়ে দেয়া দরকার।
লেখক : অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।