আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক, সরকারি, বেসরকারি শিক্ষক, মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরীক্ষা- মূল্যায়ন নিয়ে ভাবনা প্রসঙ্গ নিয়ে একটি বাস্তব ঘটনা অবতারণা করছি।
স্বাধীনতা-পরবর্তীতে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু সার্বক্ষণিক আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন। একদিন আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কেন পানি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারছেন না ? তিনি আমাকে জবাব দিলেন, ‘আমি হানিরে হানিই কই? আপনে হানি হুনতে হানি হুনেন। তিনি কোন অবস্থাতেই পানি উচ্চারণ করতে পারেনি। ঠিক তদ্রুপ আমাদের দেশে শিক্ষার সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ মানুষ মূল্যায়ন বিষয়টি বুঝতে চান না। বরং তাদের মুখ থেকে মূল্যায়নের পরিবর্তে পরীক্ষা কথা উচ্চারিত হয়ে থাকে। কোন অবস্থাতে পরীক্ষা থেকে মূল্যায়নে সরে আসতে চান না ও পারেন না।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক একদিন আমাকে বললেন, স্যার, আজ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেব। আমি বললাম,করবেন মূল্যায়ন। বললেন, পরীক্ষা কেন? তিনি বললেন, শিশুকাল থেকে পরীক্ষা দিতে ও নিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই মূল্যায়নের নাম মুখে আসেনা। এখনো আমরা ও মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নামে নম্বর থেকে বের হতে পারছিনা। এবারে পরীক্ষা ও মূল্যায়নের তফাৎ তুলে ধরছি।
পরীক্ষা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। যেমন পরীক্ষার ফি, নির্দিষ্ট তারিখ, সময়, ছাপানো প্রশ্ন, নির্ধারিত খাতা, শিক্ষার্থী, অভিভাবকের মাঝে আতংক, কেমন প্রশ্ন হবে? পারবোতো, নানা চিন্তা অভিভাবক শিক্ষার্থীর মনের মাঝে বিচরণ করতে থাকে। আবার বেশির ভাগ অভিভাবকের জিপিএ ৫ পাওয়ার উচ্চ বিলাসে মগ্ন।
তা না হলে সমাজে তাদের মান-সম্মান ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়। এ পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসার মতো। রোগীর দেহ টিপে, টাপে ঠিকমতো ওষুধ দিলে জি এফ-৫ মতো ডাক্তারের বাহবা! আর সঠিক ওষুধ না হলে ভবিষ্যতে যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে তা নিজে বা স্বজনরা উপলব্ধি করতে পারেননা। টের পায় এ পরীক্ষার মতো যখন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল, বুয়েট ও নানা কর্মস্থলে যথাযথ প্রশ্ন কমন না পড়ে। বড় জি.পি এ ৫ যেন ‘বাবু মাঝির মত সাতার না জানা, সবই যেন মিছে।’ লেখাপড়ার প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন। জ্ঞানার্জন ঘাটতি রেখে বড় বড় পাস। সবই যেন খালি কলস। পাসটা এমন হওয়া প্রয়োজন যেন কলসটা জ্ঞানে ভরপুর থাকে। এবার মূল্যায়ন নিয়ে আলোকপাত করছি। মূল্যায়ন পদ্ধতিও হলো এক ধরনের পরীক্ষা। সার্বক্ষণিক দেখভালসহ দুর্বল শিক্ষার্থীকে এগিয়ে নেওয়া। পরীক্ষায় ভুল উত্তর কাটা দিয়ে নাম্বার দিয়ে খালাস। অথচ মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষক উত্তর শিখিয়ে দায়মুক্ত হবেন। প্রতি পিরিয়ডে সীমিত সংখ্যক পাঠ শিশুদের শেখাবেন।পাঠে সার্বিক জ্ঞান যাচাই করে সামনে এগিয়ে নেবেন। এখানে নতুন পাঠ না পড়িয়ে বা শিখিয়ে বাড়ির পড়া বা কাজ দেওয়ার কোন অবস্থা কাম্য নয়। সপ্তাহ বা মাসিক মূল্যায়ন না নিয়ে অধ্যায় বা গল্প-কবিতা শেখে সার্বিক জ্ঞান যাচাইপূর্বক মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। শিক্ষককে সতর্ক থাকতে হবে যাতে শিক্ষার্থী কোন জ্ঞান থেকে বঞ্চিত না হয়। পরীক্ষার মতো মূল্যায়নে কোন ভয়ভীতি বা আতঙ্ক নেই। শিক্ষার্থীর সার্বিক জ্ঞান যাচাই হবে বলে জ্ঞানের ঘাটতি খুব কম থাকবে। শিক্ষার্থীকে মুখস্তনির্ভর শিক্ষা থেকে বের করে আনতে হবে। এ জন্য সকল ধরনের রচনামূলক প্রশ্ন পরিহার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের রচনা লেখা নিয়ে কতিপয় প্রম্ভাবনা করছি। রচনা অর্থ হলো “রচ তুমি আপন মনে”। শিক্ষার্থী নিজ পরিবেশের বিষয় আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখবে। শিক্ষক তাকে সহযোগিতা করবেন। পরীক্ষা পদ্ধতিতে রচনা কমন না পড়লে শিক্ষার্থীও মানসিকভাবে হতাশগ্রস্ত হয়। অথচ প্রাথমিক থেকে চেনা, জানা, পরিবেশের বিষয়ে নিজের মত করে দেখে লিখতে লিখতে পরবর্তীতে যেকোন রচনা বা বিষয় নিজে নিজে লেখার অভ্যাস তৈরি হবে। সার্বিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে জ্ঞাননির্ভর শিক্ষা কার্যকর হবে। হাতুড়ে চিকিৎসকের মতো জ্ঞানবিহীন পরীক্ষার ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটবে। বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতা পরীক্ষায় ফেল বা কিছু না পারার অপবাদ থেকে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক মুক্তি পাবে।
বর্তমান শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নে কতিপয় পরামর্শ ১. শিক্ষক সংকট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে।২.শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ১:২০ এ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ৩.শিক্ষকদের একটানা ক্লাস পরিবর্তে বিরতী দিতে হবে।৪. শিক্ষা উপবৃত্তি পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের জন্য আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সুলভ বা বিনামূল্যে প্রদান। ৫.জ্ঞান অর্জনমুখী শিক্ষা কার্যকর করার জন্য সপ্তাহে প্রত্যেকদিন সকল বিষয়ে পাঠদানের প্রয়োজন নেই। এতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের ওপর অহেতুক চাপ পড়ে। শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন ব্যবস্থা ফলপ্রসূ করার প্রতিটি পিরিয়ড ১ ঘন্টা করা প্রয়োজন। ৩০/৪০/৫০ মিনিটে ফুরত, ফুরত বা অনেকটা আসা-যাওয়া বন্ধ করতে হবে। ৬.শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, বিনোদন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুপুর ২টার মধ্যে ছুটি দিতে হবে।যাতে শিক্ষার্থী দুপুরে বাড়িতে গরম খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে বা বিশ্রাম নিয়ে বিকাল বেলা, খেলাধুলা বা বিনোদনের সুযোগ পায়।
৭.লিখিত ও মৌখিক মূল্যায়নের রেকর্ড শিক্ষার্থীর খাতায় থাকবে। যা মাঝে মাঝে অভিভাবকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বাড়িতে দেওয়া হবে। ৮.দায়সারা মুখস্ত মূল্যায়ন করা হলে শিক্ষককেও কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। ৯. কার্যকর মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষকের সকল চ্যালেঞ্জ দূর করতে হবে।
১০. সকল শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (কিন্ডারগার্টেন, বেসরকারি) শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈষম্য শূণ্য সহিষ্ণুতায় নামিয়ে আনতে হবে।
১১. সকল শিশুর ক্ষেত্রে অভিন্ন (বই, কর্মঘন্টা, মূল্যায়ন পদ্ধতি) চালু করতে হবে। নচেৎ সরকারের মহাস্বপ্নের কর্মযজ্ঞ চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হবে। জ্ঞান অর্জনমুখি শিক্ষায় বৈষম্য বা অবহেলা জাতির অগ্রগতির অন্তরায়। সকলের মাঝ থেকে ভুতুড়ে পরীক্ষা ব্যবস্থার মৃত্যু হোক। জয় বাংলা।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ ও সম্পাদকীয় উপদেষ্টা দৈনিক শিক্ষা ডট কম।